জাদুস্পর্শে অন্য মানুষ
দস্যু রত্নাকরের উত্তরণ ঘটেছিল মহর্ষি বাল্মীকিতে। ভুলে গিয়েছিলেন হিংসা। পেয়েছিলেন কথা, সুর। এক নতুন জীবন। তাঁকে প্রাতিষ্ঠনিকতা দিয়েছিলেন দেবী সরস্বতী। এই সময়ের রত্নাকরেরাও পেয়েছেন নতুন জীবন। তাঁদের প্রাণে জেগেছে খুশির তুফান। লেগেছে সুর। এসেছে ছন্দ। দেবী সরস্বতীর মতো তাঁদের জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছেন এক নৃত্য-সাধিকা। তিনি অলোকানন্দা রায়। তাঁর জাদুস্পর্শে অন্য মানুষ হয়ে গেছেন সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। অলোকানন্দার পরিচালনায় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এক অচেনা জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাঁদের। কোনও একজন নয়, তাঁরা প্রত্যেকেই যেন হয়ে উঠেছেন এক-একজন বাল্মীকি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর লেখা বইয়ের রেকর্ড বিক্রি
সাজাপ্রাপ্তদের কালচারাল থেরাপি
এই আশ্চর্য যাত্রার সূচনা হয়েছিল ২০০৭ সালে। জেলগুলো তখন সদ্য নাম পাল্টে সংশোধনাগার হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু নিছক নাম পরিবর্তন করলেই তো হবে না। এমন কিছু করতে হবে, যাতে বন্দিরা সত্যি-সত্যিই সংশোধিত হন। ২০০৮-এ রাজ্যের কারা বিভাগের তৎকালীন আইজি বি ডি শর্মা ঠিক করেন, সাজাপ্রাপ্তদের কালচারাল থেরাপি দেওয়া শুরু করবেন। তিনি যোগযোগ করেন নৃত্যশিল্পী অলোকানন্দা রায়ের সঙ্গে। প্রস্তাব পেয়ে অলোকানন্দা এক কথায় রাজি। তাঁর পরিচালনায় বন্দিরা নাচ ও অভিনয়ের তালিম নিতে থাকেন। ২০০৮-এ প্রথমবার মঞ্চস্থ হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’।
আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে বিজেপি নেতার ৬,০০০ কোটির পনজি স্কিম, পর্দাফাঁস সিআইডি তদন্তে
রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাট্যসাহিত্য
সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র শো করেছেন কলকাতা, বোলপুর, দিল্লি, মুম্বই, পুনে, ভুবনেশ্বর, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি জায়গায়। একজন বন্দিও ভাবেননি পালানোর কথা। আসলে পরিবেশ মানুষকে পাল্টে দেয়। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো দেন-ই। ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাট্যসাহিত্য। প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। ওই বছরই প্রথম মঞ্চায়িত হয়। এই নাটকের হাত ধরেই বাংলায় গীতিনাট্য ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অভিনয় করেছেন। বাল্মীকির চরিত্রে।
ফিরে গেছেন স্বাভাবিক জীবনে
জীবনের কোনও একটা সময় ভুল করেছিলেন সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। তাঁরা যে আবার আলোর মুখ দেখবেন, ভাবতেই পারতেন না কেউই। অসাধ্যসাধন করেছেন অলোকানন্দা। তাঁর স্নেহছায়ায় সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা শুধুমাত্র সংস্কৃতির ছোঁয়া পাননি, তাঁদের অনেকেই ফিরে গেছেন স্বাভাবিক জীবনে। দেখেছেন আলোর মুখ। সমাজে-সংসারে তাঁদের গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। তাঁরা বেছে নিয়েছেন নানারকমের পেশা। অলোকানন্দা হয়ে উঠেছেন তাঁদের মা। এতজন সন্তানকে নিয়ে আনন্দে আছেন এই নৃত্য-সাধিকা।
আরও পড়ুন-অভিষেকের প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলেন না কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী
প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ
১৬ বছরের পথচলা। যাঁদের নিয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ শুরু হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই আর এই প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত নেই। যদিও ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে অলোকানন্দার সঙ্গে। তৈরি করে নিতে হয়েছে নতুনদের। যেখানেই মঞ্চস্থ হয়েছে, প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দর্শকরা। তবে এই প্রযোজনা দেখা যাবে না আর। ১৭ নভেম্বর, কলকাতার রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হল ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র শততম এবং শেষ অভিনয়। প্রেক্ষাগৃহ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অনবদ্য উপস্থাপনা। গানের তালে তালে নৃত্য এবং অভিনয়ে নিজেদের সেরাটুকু উজাড় করলেন প্রত্যেকেই। আলো এবং সাজসজ্জাও ছিল দেখার মতো। নৃত্যনাট্যের শেষে দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করেন পরিচালক অলোকানন্দা এবং অন্যান্য কলাকুশলীকে। অলোকানন্দা অভিনয় করেন দেবী সরস্বতীর ভূমিকায়। বাল্মীকির চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন সুমিত।
ইতি টানার সেরা সময়
কথা হল অলোকানন্দা রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা সময় থামতেই হত। থামতে হয় চাহিদা থাকতে থাকতেই। আমার মনে হল ইতি টানার এটাই সেরা সময়। শততম মঞ্চায়ন যে কোনও প্রযোজনার ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখযোগ্য। তাই আমরা এই শোকেই শেষ শো হিসেবে বেছে নিলাম। তাছাড়া আগের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রায় সবাই এখন মুক্ত। নতুন অভিনেতা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। শততম শো-তে মাত্র একজন অভিনেতাই অংশ নিয়েছেন, যিনি ২০০৮-এ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র প্রথম শো-তেও অভিনয় করেছিলেন। বাকিরা অধিকাংশই ফিরে গেছেন সমাজের মূলস্রোতে। ঠিক যে ভাবে দস্যু রত্নাকরের উত্তরণ ঘটেছিল মহর্ষি বাল্মীকিতে।
আমূল বদলে দিয়েছে
তিনি আরও বলেন, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ আমার, আমাদের জীবন আমূল বদলে দিয়েছে। অর্থ উপার্জনের সুযোগ খুব বেশি পাইনি। তবে আমার ছেলে-মেয়েদের কাছে যে সম্মান, ভালবাসা পেয়েছি, তার কোনও তুলনাই হয় না। এইরকম প্রাপ্তি অনেকের জীবনেই ঘটে না। আর মঞ্চস্থ হবে না এই প্রযোজনা, এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। তবে আমরা কিন্তু এখানেই থামছি না। দর্শকদের উপহার দেব নতুন নতুন প্রযোজনা। যিশুকে নিয়ে পুরোনো প্রযোজনাটি আবার মঞ্চস্থ করব। প্রেসিডেন্সি, মেদিনীপুরের পাশাপাশি দলে নেব দমদম সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদেরও।
অনেক কাজ বাকি
‘বাল্মীকি প্রতিভা’র শততম মঞ্চায়নের দিনে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত পুরোনো বন্দিও। তাঁদের কেউ কেউ আগে এই প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন। শততম মঞ্চায়নের শেষে বি ডি শর্মা-সহ কয়েকজনকে সংবর্ধিত করেন অলোকানন্দা। সবাইকে জানান আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। এগিয়ে চলবেন তিনি। শান্ত দুটি চোখ এবং প্রাণখোলা হাসি নিয়ে। তাঁর যে আরও অনেক কাজ বাকি।