কেমন আছেন?
বয়স ৯০। এই বয়সে যেমন থাকা যায়, তেমন আছি। টুকটাক পড়াশোনা করছি। সঙ্গে নিজস্ব লেখালেখি। পাশাপাশি ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। ৭৩ বছর ধরে বেরচ্ছে এই পত্রিকা। আমি সম্পাদনা করছি প্রায় ২৫ বছর। তার আগে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় আসন বিন্যাস
তাঁদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন কীভাবে?
গজেন্দ্রকুমার মিত্রের স্ত্রী ছিলেন প্রতিমা দেবী। তাঁর ছিল এক অবৈতনিক পাঠশালা। আমার মা সেই পাঠশালায় আমাকে ভর্তি করে দেন। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন কাকাবাবু গজেন্দ্রকুমার মিত্রও। তখন থেকেই আমি এই বাড়িতে থেকে গেলাম। সেই আসা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তারপরে আলাপ হল সুমথনাথ ঘোষের সঙ্গে।
প্রকাশনার কাজে যোগ দিলেন কোন সময়ে?
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার পরে। সেই সময় আমি একটা কাজ খুঁজছিলাম। কারণ পরিবার ছিল আমার উপর নির্ভরশীল। কাকিমাই আমাকে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড-এ যোগদান করার পরামর্শ দেন। ১৯৪৯ সালের মে মাসে আমি মিত্র ও ঘোষে কাজে যোগ দিই। তখন আমার বয়স ১৫-র মতো। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে তারও পরে।
আরও পড়ুন-লাল-গেরুয়া ভাই ভাই, স্ক্যামে ওরা জগাই-মাধাই
অন্য কোথাও চাকরির কথা ভাবেননি?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছিলাম। তবে সেই চাকরি আমি করিনি। কারণ মিত্র ও ঘোষের আড্ডা এবং সাহিত্যিকদের পরম সান্নিধ্য ছেড়ে আমি বেরোতে পারিনি। দেখতে দেখতে কবেই সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সেই সময় আমি স্নেহ পেয়েছি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবীর। তারাশঙ্করবাবুকে আমি খুব সমীহ করতাম। পরবর্তী সময়ে উনি হয়েছিলেন আমার কুটুম।
কীভাবে?
উনি ছিলেন আমার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের লোক। আমার স্ত্রী ছিলেন অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। দেখাশোনার সময় আমি যাইনি। গুরুজনরা তাঁকে পছন্দ করেছিলেন। তারাশঙ্করবাবু সব শুনে বলেছিলেন, ‘যাও, মেয়েটিকে একবার দেখে এসো। সে তোমাকে পছন্দ করে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে!’ আমি মেনেছিলাম তাঁর পরামর্শ।
আরও পড়ুন-কাবুলে বিস্ফোরণ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল?
দুজনের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এককথায় অসম্ভব ভাল। একে অপরকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন, পরস্পরের লেখার প্রশংসা করতেন। এইসব আমার নিজের চোখে দেখা। তুলনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এঁদের যোগাযোগ ছিল কিছুটা কম। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত মানুষ। ওঁর আমন্ত্রণে আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। একবার একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সৈয়দ মুজতবা আলী গীতা-র একটি অংশ পাঠ করেছিলেন। শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আপনার লেখা বেশ কিছু বই আছে। সবই মূলত প্রকাশনা সংক্রান্ত। ক্রিয়েটিভ লেখালিখির দিকে গেলেন না কেন?
জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রুফ দেখেছি। যার ফলে প্রচুর পড়তেও হয়েছে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমি লিখলে এই সমস্ত লেখার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারব না। সেই কারণে আর চেষ্টা করিনি। তবে আমি এমন অনেক সাধারণ মানুষকে দেখেছি যাঁদের নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা যেত। ছাপাখানা এবং বাঁধাইঘরের মানুষ তাঁরা। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন তাঁদের। তবে আমি লিখে উঠতে পারিনি। হয়তো সেই ক্ষমতা আমার ছিল না।
প্রকাশনা জগতের এখন অনেক বদল ঘটেছে। এই পরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আরও পড়ুন-বাংলার উন্নয়ন রুখে দিতে চাইছেন বিরোধী দলনেতা
অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিল ধাতব টাইপ। এখন কম্পিউটার, ডিজিটাল যুগ। ইন্টারনেটের যুগ। টেকনোলজির উন্নতি হয়েছে। সেটা ভাল। যদিও আমি খুব একটা ব্যবহার করতে পারি না। তবে মিত্র ও ঘোষ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। বহু আগে আমরা ই-বুক প্রকাশ করেছি। যদিও মুদ্রিত বইয়ের তুলনায় ই-বুকের বিক্রি খুব কম। তাছাড়া ই-বুকে স্পর্শের আনন্দও নেই।
বইপাড়ায় আপনার পরিচিতি ‘ভানুবাবু’ নামে। ডাকনামটি কে রেখেছেন?
আমার দাদামশাই। আমরা তিন ভাই। দাদামশাই তিন ভাইয়ের ডাকনাম দিয়েছিলেন দানু, ভানু, পিনু। এই ৯০ বছর বয়সেও সেই ডাকনামটি আমি বয়ে বেড়াচ্ছি।
এখন কী বই লিখছেন?
আমার দেখা বিভিন্ন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের নিয়ে একটি বই লিখছি। বইমেলায় মিত্র ও ঘোষ থেকে বেরোবে। নাম ‘আমার জীবন আমার জগৎ’। জানি না, এরপর আর কোনও বই লিখতে পারব কিনা!