বাংলা দিবস মানে বাঙালিয়ানা, বাংলা দিবস মানে সম্প্রীতি সৌহার্দ আর শান্তি ষোলো আনা

অস্তিত্বরক্ষার ইঁদুরদৌড়ে নাভিশ্বাস তোলা এই ছুটন্ত সময়েও কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটতে থাকা এক জাতি বাঁচে নিজের নিয়মে। সে জাতির নাম বাঙালি জাতি। তাঁদের বঙ্গভূমি সার্থক যেন মানবাত্মার মিলনক্ষেত্র। 'মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ'। লিখছেন চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

বিশ্বায়িত পৃথিবীতে কর্মব্যস্ততার লাগাম মুখে এঁটে ছুটছে একটা গোটা সভ্যতা। নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে ভাবার সময় কোথায় এখন মানুষের? যে দুনিয়ায় প্রতি মিনিটে জন্ম নিচ্ছে নতুন একটা বৃদ্ধাশ্রম, সেখানে জননী-জন্মভূমির প্রতি অটুট আবেগ আজ সত্যিই বিরল। যেখানে গোটা একটা পৃথিবীর দিনক্ষণ রোজ মাপা থাকে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারে, সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতির দিনলিপিকে নিয়ে আদিখ্যেতা বিলাসিতা বই কী! তবে অস্তিত্বরক্ষার ইঁদুরদৌড়ে নাভিশ্বাস তোলা এই ছুটন্ত সময়েও কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটতে থাকা এক জাতি বাঁচে নিজের নিয়মে। তার যেন ছকভাঙাতেই আনন্দ! সে দেশ বাস্তবতার নিঠুরতা থেকে অনেক দূরে।

আরও পড়ুন-মোহন-আমন্ত্রণ এড়িয়ে ইস্টবেঙ্গলে ক্রীড়ামন্ত্রী

সে দেশে স্বপ্লিল চোখে, স্মৃতির মেদুরতায় ঐক্যবদ্ধ মানুষ হেসে ওঠে আজও। তাই তো পূর্ব ভারতের এক শহর নিঃশব্দে ফেরি করে চলে মুঠোভরা হাসি। সে শহরের অলিগলিতে দুঃখে মুছে লেখা হয় আনন্দের উপাখ্যান। কলকাতা কার্যতই‍‘সিটি অফ জয়’— উদযাপনের শহর। আন্তরিকতা যে বাংলার মূলধন, সেখানে শিকড়কে ভোলার অবকাশ কোথায়! তাই তো সারাবছর জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের কঠোর অনুশাসনে হাঁফিয়ে ওঠা ছেলেটা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় বছরের ওই একটা দিন। বাঙালির ৩৬৪টা দিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারে বাঁধা থাকলেও একটা দিন শুধুমাত্র বেণীমাধব শীলের ফুলপঞ্জিকার, যেদিন বাঙালি বাংলায় চোখ রেখে খুঁজতে চায় ইংরেজিকে— পয়লা বৈশাখ। কর্পোরেটের কেতাদুরস্ত কর্মী থেকে কোন্নগরের কাটলেট বিক্রেতা কিংবা ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি অনার্স, সবার মুখে প্রশ্ন থাকে একটাই— পয়লা বৈশাখ ক্যালেন্ডারে এবার চোদ্দো না পনেরোই এপ্রিল! ১লা বৈশাখ তাই কখনওই একলা নয় কিছুতেই, বরং সে সর্বজনীন।
এ বঙ্গভূমি সার্থক যেন মানবাত্মার মিলনক্ষেত্র। গুপ্তযুগে অঙ্কুরিত এক জাতির বিস্তার অনন্য ইতিবাচক মাত্রা পায় পাল, সেনদের মতো হিন্দু রাজার হাত ধরে আর তারপর সেই বিস্তার পরিপূর্ণতা লাভ করে সুলতানি আমলে। রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয় বাঙ্গালাহ বা বাংলা এবং বাংলা রাষ্ট্রের অধিবাসীরা পরিচিত হয় বাঙালিয়া বা বাঙালি নামে। এই সুলতানি আমলেই সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তৈরি হয় একটি সাধারণ ভাষা, যা পরিচিতি পায় বাংলা ভাষা নামে। সভ্যতার ইতিহাসে যে জাতির ডানা মেলা-ই দুটি ভিন্ন ধর্মের সম্মিলিত প্রয়াসে, সেই মাটির গল্পই পরবর্তীতে কাব্য হয়ে ঝড়ে পড়ে ধূমকেতুর আগুনে— “মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।” যে পয়লা বৈশাখ বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতার এক অনন্য নিদর্শন, যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু দেবতা সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা; সেই বাংলা সাল, মাস এমনকী এই পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উৎসবও আদতে মুঘল সম্রাট আকবরের সূচনা। মুসলিম মালিকানাধীন বহু দোকানে আজও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে শাস্ত্রীয় আচার মেনে পূজিত হন মূষিকরাজ গজপতি, মঙ্গলঘটের আম্রপল্লব আসে কোনও এক মুসলিম পরিবারের উঠোন থেকে অর্থাৎ ইতিহাস ও উদ্দীপনায় পয়লা বৈশাখ সততই যেন ধর্মীয় বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালিয়ানার উদযাপন যেখানে অনুরণিত হয় বঙ্গদেশের চিরন্তন ঐক্যতান সুর। সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের সংমিশ্রণে এই বাংলার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ নিঃসন্দেহেই তাই একমেবঅদ্বিতীয়ম।

আরও পড়ুন-নতুন গান বেঁধে রাজ্যবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

বাংলা মায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলেছিলেন। ‘দেশ’ নামক মনুষ্যসৃষ্ট সংকীর্ণতাকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বগ্রামের বিস্তার তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বারংবার। তাঁর কলমে ধ্বনিত হয়েছে বেঁধে থাকার সুর— মনুষ্যলিপ্সা মাটিকে টুকরো করতে পারলেও আকাশ আজও অবিভক্ত। আকাশকে কাঁটাতারের অভিশাপে রক্তাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। বঙ্গদেশ বিভাজন নয়, মিলনের তীর্থক্ষেত্র। নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট‌্রেলীয়ের মতো পৃথিবীর প্রাচীন চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীরই নিদর্শন মেলে বাংলার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসে। পরবর্তীতে বিশ্বকবির কলমেও অনুরণিত হয়েছে— “শক, হুন, দল, পাঠান, মোগল/ এক দেহে হল লীন।” সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাজধানী যে বাংলা ১৯০৫ সালে রাখিবন্ধন উৎসবের মাধ্যমে গর্জে উঠেছিল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, তাদের কাছে দেশভাগ অন্ধকারতম অভিশাপ। কাঁটাতারের পেরেক শুধু বনগাঁ কিংবা হিলি সীমান্তের ধুলোমাটিকে নয়, ক্ষতবিক্ষত করেছিল প্রতিটি বাঙালির ঐক্যপ্রেমী হৃদয়কে। রক্ত ঝরেছিল নীরবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতো পাঁচবছরে একবার রবীন্দ্রনাথের ভেক ধরে বঙ্গদেশে ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে বাঙালির আবেগকে অনুধাবনের প্রয়াস আদতে পাথর ছুঁড়ে পাহাড় ভাঙার শামিল। বাঙালি সংকীর্ণতা নয়, উদারতার উপাসক। ২০ জুন তারিখটি তাই বাঙালিকে পীড়া দেয়। ১৯৪৭ সালে যে অভিশপ্ত দিনে গোকুল হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রিয় প্রতিবেশী গফুরকে, বিষাদময় যবনিকা নেমে এসেছিল আকাশ-আমিনার প্রেমকাহিনিতে; সে দিন বাঙালির কাছে উদযাপনের নয়, উপরন্তু ভয়াবহ বিষণ্ণতার। ২০ জুন তারিখটি আদতে হিন্দু এবং বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে লড়াইয়ের প্রতিফলন। সংঘ পরিবার ২০ জুনকে পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও সংহতিপ্রেমী বাঙালি মননে সে এক অন্ধকারময় অধ্যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যে স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ভারত, ঐক্যবদ্ধ বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত চুরমার হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন। ওইদিন ইরেজ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটন তাঁর দেশভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন সদর্পে। গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় দেশভাগের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সোচ্চার হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। কিন্তু, ৩ জুনের পরে আর ইংরেজদের এই পরিকল্পনাকে আটকানো যায়নি কিছুতেই। কারণ, ততদিনে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি স্বীকার করে নিয়েছে এই পার্টিশন প্ল্যানকে। তারপর ২০ জুন আইনসভায় যা ঘটেছিল, তা আমাদের দেশ তথা বাংলা ভাগের এক মর্মান্তিক ইতিহাস। সম্প্রীতির সেবাইত পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে তাই ২০ জুনের অভিশপ্ত লগ্ন নয়, বরং পয়লা বৈশাখ এক উদযাপনের দিন— যেদিন অবিভক্ত সূর্যের প্রথম রোদ গায়ে মেখে কাঁটাতারের বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে দুই বাংলা একসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে গেয়ে ওঠে—
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল —-পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥”

Latest article