বয়স-ঘড়ি

নিজের বয়স-ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন শিবশংকর সেনশর্মা। সময় যেন দ্রুত হয়ে আসছে। এই তো সেদিন কাঁটাটা সদ্য চুয়ান্নর ঘর পেরোল।

Must read

অভিজ্ঞান দাস
নিজের বয়স-ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন শিবশংকর সেনশর্মা। সময় যেন দ্রুত হয়ে আসছে। এই তো সেদিন কাঁটাটা সদ্য চুয়ান্নর ঘর পেরোল। আর এখনই সেটা পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই!
সময়ের কাঁটার সঙ্গে বোধহয় মানুষের কর্মক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে। যখন কর্মক্ষমতা তুঙ্গে থাকে, তখন মনে হয় সময় যেন দ্রুত পেরিয়ে গেল, দিনটা যদি আটচল্লিশ ঘণ্টার হত। আর দিন যখন ফুরিয়ে আসে, সময় যেন আর কাটতে চায় না। সবটাই মনে হওয়া, সবটাই আপেক্ষিক। কিন্তু যদি এই আপেক্ষিকতাটুকুও অন্তত পালটে দেওয়া যেত। বৃদ্ধ বয়সে জীবনযাপনের প্রাত্যহিক গ্লানি কত মানুষেরই না কমে যেত।
এই বয়স-ঘড়িটাকে আবিষ্কার করেও তাই সর্বসমক্ষে আনেননি। এখন যে অবস্থায় এটা আছে, তাতে কারও হাতে এটা পৌঁছলে বয়সকালীন অবসাদ আর আতঙ্ক আরও বাড়বে। সবাই তো আর শিবশংকর সেনশর্মা নয়!
তার বয়স-ঘড়িতে ঠিক একশোটাই ঘর আছে। ঘর আরও বাড়ানো যেত। ইচ্ছে করেই বাড়াননি। একশোর পর মানুষ বাঁচে না তা নয়—অনেক মানুষই বাঁচে। তবে তখন আর হিসেবনিকেশের কিছু থাকে কি? থাকলেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ শিবশংকর। সে জীবনের এর কোনও তাৎপর্য থাকে বলে তিনি মনে করেন না। তাঁর ঘড়িতে তাই সর্বোচ্চ সময়সীমা ওই একশো বছর। অবশ্য একশো কেউ পেরলে ঘড়ি নতুন করে তার গণনা শুরু করবে।
 তবে এই ঘড়ি যেটা করে, সেটা জটিল হলেও ঘড়িটা ব্যবহার করা ততটা জটিল নয়। শুধু একবার কব্জিতে পরে ফেললেই হল। ঘড়ির একটা কাঁটা একেবারে একটা জায়গায় গিয়ে পুরোপুরি স্থির হয়ে যাবে। যে বিন্দুতে স্থির হবে সেটা মানুষটির জীবনকাল। শিবশংকরের হাতে পরা ঘড়িটাতে এই বড় কাঁটাটা দাঁড়িয়ে আটাত্তর আর ঊনআশির মাঝখানে। মানে শিবশংকর আটাত্তর বছরের কিছু বেশিদিন বাঁচবেন। এখন চলছে সাতান্ন। হাতে বেশিদিন সময় নেই। ঘড়ির চলমান কাঁটাটি টিকটিক করে এগোচ্ছে থমকে যাওয়া কাঁটাটিকে ছুঁতে।
 মানে যারা জীবনকে কাজের একটা মঞ্চ হিসেবে ধরে জীবদ্দশায় নিজের কাজ শেষ করে যেতে চায়, এ ঘড়ি তাদের আরও প্ল্যান করে এগোতে সাহায্য করবে, সময় শেষ হয়ে আসছে বুঝলে তাদের কাজের গতি আরও বাড়বে, যেমন বাড়ে কলমের গতি, পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা যত এগিয়ে আসে, তত। কিন্তু তেমন মানুষ আর ক’জন?
 হারাধন টিফিন নিয়ে এল। মুড়ি, আলুকাবলি আর শসা। শিবশংকরের প্রিয় খাদ্যগুলোর একটা। হারাধন বাটিগুলো নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে ফিরে যাচ্ছিল,
 কী মনে হল, ডাকলেন শিবশংকর, ‘‘শোন একবার।’’
 হারাধন ঘুরে এল। নিজের হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রিসেট করলেন। তারপর বললেন, ‘‘বাঁ-হাতটা বাড়া।’’ হাতটা বাড়াতে বাড়াতে হারাধন বলল, ‘‘এটা কি লোতন ভূত-যন্তর?’’
 ও এইরকমই বলে। কম দিন তো হল না শিবশংকরের সঙ্গে ঘর করছে। এসব আবিষ্কারের মাথামুন্ডু ওর মাথায় ঢোকার কথা নয়। এগুলোকে ও তাই ভূত-যন্তর বলে। ঘড়িটা হারাধনের হাতে পরিয়ে দিয়ে শিবশংকর বললেন, ‘‘যা চা-টা নিয়ে আয়। দেখিস যেন জল-টল না লেগে যায়।’’
 হারাধন চা নিয়ে এল মুড়ির বাটিটা নামিয়ে রাখার পরই। হাত বাড়িয়ে চা-টা নিয়ে বললেন, ‘‘দে, ঘড়িটা খুলে দে।’’ হারাধন ঘড়ি খুলছে, সেদিকে তাকিয়ে শিবশংকর টের পেলেন তিনি মৃদুমন্দ ঘামছেন। মানে তার টেনশন হচ্ছে। এই কারণেই তিনি ঘড়িটা এতদিন পরাননি ওকে।
 ঘড়িটা হাতে পেয়ে শিবশংকর দেখলেন, বড় কাঁটাটা ছিয়াত্তরে গিয়ে থমকেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। স্বস্তির নিশ্বাস। শিবশংকর বুঝলেন, এই স্বস্তি তার বুড়ো বয়সে একলা না হয়ে যাওয়ার স্বস্তি। হারাধন তার চেয়ে দশ বছরের ছোট। তার মানে, তিনিই আগে যাবেন।
 চায়ে চুমুক দিতে দিতে উঠে পড়লেন। আর পাঁচটা মানুষের থেকে তাহলে তিনি আলাদা কিছু নন। মৃত্যুভয় হয়তো আসেনি, কিন্তু একাকিত্বকে তিনিও তাহলে ষোলো আনা ভয় করেন? আর যেটা ভাবছিলেন, শেষের সেদিনের কথা আগেভাগে জানতে পারলে কারও কারও ক্ষেত্রে কাজের গতি বাড়ে, সেটাই বা তাহলে সত্যি কি করে হয়?
 বড় দোটানায় পড়ে গেলেন শিবশংকর। কী করবেন এই বয়স-ঘড়ি নিয়ে? যে আবিষ্কার মানুষের কাজে লাগবে না তাকে তিনি আবিষ্কার বলেই মনে করেন না। কিন্তু আবিষ্কারটা যে বেশ যুগান্তকারী, তাও তো মানতেই হবে। বেশিদিন নয়, মাত্র বছর তিনেক আগে একটা জার্নালে লেখাটা পড়েছিলেন। এই জার্নাল পড়েই শিবশংকরের মাথায় বয়স-ঘড়ির চিন্তাটা উসকে দেয়। শিবশংকরের এই যন্ত্র মাইক্রো ব্লাড- সার্কুলেশন ফলো করে সম্ভাব্য বয়স মেপে ফেলে।
 নিজের মনে ঘাড় নাড়তে নাড়তে ল্যাবে এসে ঢুকলেন। এমন একটা কিছু এই যন্ত্রে যোগ করতে হবে যাতে বয়সজনিত এইসব অবসাদ আর আতঙ্ক তাড়িয়ে দিয়ে জীবনের শেষ দিনটা চিনে ফেলার পর মানুষ আরও বেশি সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে, আরও বেশি প্রোডাক্টিভ।
 অন্যমনস্কভাবেই যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করছিলেন। এমন সময় ল্যাবের দরজায় টোকা পড়ল। কে আর আসবে তার কাছে? আসার লোক তো শুধু ওই তুলসী। ছেলেবেলা থেকে দু’জনে হরিহর আত্মা বন্ধু।
 উঠে গিয়ে দরজা খুলতে তুলসী ঢুকে এল। আর শিবশংকরের মাথাতেও এসে হাজির হল একটা প্ল্যারন। কথায় কথায় শিবশংকর বললেন, ‘‘গত সপ্তাহে কলকাতায় গিয়েছিলাম তোর খেয়াল আছে?’’
 ‘‘হ্যাঁ, কেন?’’
 ‘‘দিদির বাড়িতে এক জ্যোতিষ এসেছিল। দিদি তো নাছোড়বান্দা। আমার হাত দেখাবে। আমিও রাজি নই। হঠাৎই সে ব্যাটা বলে, সে নাকি কপাল দেখেই ভবিষ্যৎ বলতে পারে।’’
 ‘‘তারপর?’’
 ‘‘তারপর আর কী, বলে আমি নাকি আটাত্তর বছর বাঁচব।’’
 ‘‘ইন্টারেস্টিং। তারপর?’’
শিবশংকর দেখলেন তুলসী বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বললেন, ‘‘কেন রে তোর কি আবার এ-ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে নাকি?’’
‘‘ সে আর কার না থাকে বল?’’
‘‘তুই কবে মরবি সেটা জানতে চাস?’’ শিবশংকর বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
‘‘হ্যাঁ চাই। তুই আর বুঝবি কী শিবু, তুই তো আর সংসার করিসনি। সংসারের জ্বালা কী করে বুঝবি? কবে পাপমুক্তি হবে জানতে চাইব না?’’
 শিবশংকর এবার নড়েচড়ে বসলেন। ‘‘সত্যিই তুই জানতে চাস?’’
‘‘হ্যাঁ সত্যিই।’’ উত্তর দিল তুলসী।
 ‘‘বেশ। আমি যদি তোকে জানিয়ে দিতে পারি, তুই শুনবি?’’
 ‘‘তুই! তোর ওইসব যন্তরপাতি দিয়ে?’’
শিবশংকর কোনও উত্তর দিলেন না। নিজের হাত থেকে বয়স-ঘড়িটা খুলে বললেন, ‘‘হাতটা বাড়া।’’
 তুলসী মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতটা বাড়িয়ে দিল। বাড়ানো হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিল শিবশংকর। এবার মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে হবে। তুলসীর বায়োলজিক্যাল ইনফর্মেশনগুলো নিয়ে উত্তর বার করতে এই সময়টুকু ঘড়িটা নেবে।
 শিবশংকর চেয়ারে বসে পড়তেই অধৈর্য হয়ে উঠল তুলসী, ‘‘কী হল রে?’’
 ‘‘কিছু নয়। দাঁড়া, মিনিট পনেরো সময় দে।’’
 ঠিক পনেরো মিনিটই লাগল। আর এই পনেরো মিনিটে অদ্ভুত এক জিনিস লক্ষ করলেন শিবশংকর। বন্ধুর সঙ্গে বসে গল্প করা তো দূরের কথা, ভীষণ ছটফট করছে তুলসী। উঠছে, বসছে, পায়চারি করছে।
 পনেরো মিনিট পর তুলসীর হাতঘড়িতে বড় কাঁটাটা সত্তরের ঘরে গিয়ে স্থির হল। অর্থটা বুঝিয়ে বলতে তুলসী খানিকক্ষণ অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল—
‘‘তোর কত?’’
শিবশংকর নিজের হিসেব বললেন। সেটি শুনে আরও গুম হয়ে গেল তুলসী। গল্পগুজব সেদিন আর হল না। দু-এক কথার পর তুলসী বাড়ি চলে গেল।
 কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে খেয়ালই রইল না তুলসী আসছে না। যে বন্ধু দু-একদিন ছাড়া ছাড়া আসত, হঠাৎ করে দু’সপ্তাহ তার কোনও পাত্তা না থাকতে মন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তুলসী এলও না। বদলে একদিন এল তুলসীর ছেলে রতন। মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ উদ্বিগ্ন। শিবশংকরও উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কি রে?’’
 ‘‘জেঠু, তুমি একবার চলো আমাদের বাড়ি।’’
 ‘‘কেন রে?’’
‘‘বাবা কেমন হয়ে যাচ্ছে জেঠু। তোমার বাড়ি থেকে যাওয়ার পর দু’দিন কী হল, গোঁজ হয়ে বসে রইল নিজের ঘরে। কারও সঙ্গে কথাবার্তাও বিশেষ বলল না। তারপর হঠাৎ মিস্ত্রি ডেকে বসতবাড়িটা ভাগ করছে। বাবার মাথায় ঢুকেছে, বাবা যদি হঠাৎ করে চলে যায়, তাহলে সম্পত্তি নিয়ে আমরা দু’ভাই লাঠালাঠি করব।’’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল রতন।
 কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘‘যতক্ষণ মিস্ত্রিদের সঙ্গে আছে ঠিক আছে। কাজ করছে, কথা বলছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, সন্ধেবেলা হলে তো সেই যে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকছে…’’
 রতন বাক্য শেষ করল না। যা বোঝার বুঝে গেলেন শিবশংকরও। দ্রুত ঠিক করে ফেললেন ইতিকর্তব্য।
আগে মেরামত করতে হবে ঘড়িটাকে। এমন কিছু করতে হবে, যাতে সেটা একেকবার একেকরকম রিডিং দেয়। তুলসীর কাছে প্রমাণ করতে হবে, যন্ত্রটাই আসলে ঠিকঠাক বানাতে পারেননি। আর তারপর, তুলসীর বাড়ি থেকে ঘুরে এসে, ফেলে দিতে হবে ওটাকে পুকুরে।
প্রকৃতির নিয়মে মানুষের হস্তক্ষেপ সে পছন্দ করে না। সারা পৃথিবী জুড়েই তো তার প্রমাণ মানুষ এখন পেতে শুরু করেছে। তবে আর কেন সে বিড়ম্বনায় তিনি নতুন আরেকটা যোগ করেন? বিজ্ঞানের লক্ষ্য তো তা নয়ও, বিজ্ঞানীর সাধনাও এটা নয়। তাছাড়া অনিশ্চয়তা আছে বলেই তো জীবন এত সুন্দর, এত রূপ-রস। অনিশ্চয়তা আছে বলেই মানুষ দুঃসময়েও স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন। সে জীবনকে স্তব্ধ করে দেবার অধিকার তো তার নেই, কারওরই নেই।
 রতনের পিঠে আশ্বাসের হাত রেখে শিবশংকর বললেন, ‘‘তুই এখন যা, আমি একটু পর যাচ্ছি।’’
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article