সাবধান! ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে বিজেপি

বিজেপির (BJP) কি আদৌ কোনও অধিকার আছে, নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলার? উত্তর ও মধ্যভারতের যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা বিজেপির জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেগুলো গোটা ভারতে নারীনিগ্রহের তালিকায় শীর্ষে। লিখছেন অধ্যাপক ড. অর্ণব সাহা

Must read

আরজি কর হাসপাতালে তরুণী জুনিয়র ডাক্তারের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার সকলেই। রাজ্যব্যাপী জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিতে যখন গোটা বাংলার অজস্র রোগী বিপুল অসুবিধায় পড়েছেন, হাজার হাজার অপারেশন বন্ধ, সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল রাজ্যের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের চিকিৎসা স্তব্ধ করে দিয়ে জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্য ভবনের সামনে বসেছিলেন ধরনায়, তখনও, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেননি। যদিও সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তাঁরা কাজে যোগ না দিলে রাজ্য সরকার যদি আইনি ব্যবস্থা নেয়ও, তাঁরা কোনও হস্তক্ষেপ করবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছেন, তাঁরাও ডাক্তারদের এই ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে সম্মান করেন, তাঁরাও জুনিয়র ডাক্তারের এই নৃশংস মৃত্যুর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি চান। এখানেই শেষ নয়, গোটা ভারতের বিগত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে যা অভূতপূর্ব, খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গেলেন ধরনামঞ্চে। হাতজোড় করে জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে আবেদন করলেন কর্মবিরতি তুলে নেবার জন্য। সকলেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৮৩ সালে এই আরজি কর হাসপাতালেই জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট পুলিশ, ক্যাডার ও কো-অর্ডিনেশন কমিটির লোকজনদের দিয়ে পিটিয়ে তুলে দিয়েছিল জ্যোতি বসুর পুলিশ। তার তুলনায় মমতা তো ঈশ্বরের সমান। ক্ষমতা নিজে নত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের বিরুদ্ধে, ভূ-ভারতে এ জিনিস কেউ কি দেখেছেন এর আগে? অথচ দেখুন, কোনও বাজারি চ্যানেল আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর এই অসাধারণ নমনীয়তাকে নিয়ে কোনও ‘স্টোরি’ করেনি। এবং তারপরেও বহু নাটক করেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। অবশেষে, ২১ সেপ্টেম্বর থেকে আংশিক কর্মবিরতি তুলে নিয়েছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন-দেউচায় ফের ৯ জমিদাতার হাতে চাকরির নিয়োগপত্র

কিন্তু এটা সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পিছনে রয়েছে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি। দীর্ঘদিন ক্ষমতা-হারানো বামেরা এটাকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজেপিও এর পিছনে রয়েছে, তা বুঝতে খুব বেশি প্রজ্ঞার দরকার হয় না। এমনকী ‘পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ’-এর বকলমে বিজেপি ও সঙ্ঘ-পরিবার যে তাদের এবিভিপি ও অন্যান্য শাখা-সংগঠনের ডাকে ‘নবান্ন অভিযান’-এর ডাক দিল এবং এবং একটি আদ্যন্ত ফ্লপ শো উপহার দিল রাজ্যবাসীকে, তার পিছনেও ছিল আরজি করের ঘটনাকে সামনে রেখে নৈরাজ্য সৃষ্টির সুপরিকল্পিত ছক। যদিও সেদিনের মিছিলে ছাত্র নয়, ছাত্রদের বাবা-কাকা-জ্যাঠাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। বাংলার মানুষ এই অপচেষ্টাকে পাত্তাও দেয়নি, বরং বিরক্ত হয়েছে। ‘দফা এক দাবি এক/ মমতার পদত্যাগ’—এই হিংস্র শ্লোগান বাংলার মানুষ মোটেই মেনে নেয়নি সেদিন।
কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। বিজেপির কি আদৌ কোনও অধিকার আছে, নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলার? উত্তর ও মধ্যভারতের যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা বিজেপির জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেগুলো গোটা ভারতে নারীনিগ্রহের তালিকায় শীর্ষে। ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের হাথরসের দলিত মেয়েটির গণধর্ষণ ও দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার চারবছর পূর্ণ হল। কিন্তু এখনও মেয়েটির পরিবার সম্পূর্ণ গৃহবন্দি। মৃতার দাদার অভিযোগ, ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও এখনও মেলেনি সরকারি চাকরি বা হাথরস জেলার বাইরে অন্যত্র ঘর। উলটে নির্যাতিতার পরিবারের জন্য সরকারি চাকরি, ঘরের নির্দেশের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় উত্তরপ্রদেশ সরকার। যদিও সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন নির্যাতিতার ভাঙাচোরা বাড়িতে মোট আটটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে, যাতে কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে সবকিছুই নজরদারির আওতায় থাকে। অথচ হাথরস জেলা আদালতের রায়ে মুক্তি পেয়ে অভিযুক্ত তিন জন খুলে-আম ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃতার দুই ভাইয়ের কোনও চাকরি নেই। তারা গ্রামের বাইরেও যেতে পারে না। স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে গেছে তাদের।

আরও পড়ুন-উত্তপ্ত লেবানন-ইজরায়েল: ধুলিসাৎ হিজবুল্লার ৩০০ ঘাঁটি, মৃত ১৮২

৩১ অক্টোবর একটি ভাষণে নারী নির্যাতনে অপরাধীদের দ্রুত সাজার পক্ষে সওয়াল করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অথচ তাঁর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতেই আইআইটি-বিএইচইউয়ের ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত বিজেপির আইটি সেল-এর দুই সদস্য গ্রেফতারির সাত মাসের মধ্যে জামিন পেয়ে গেছে। জেল থেকে বেরোনোর পর তাদের রীতিমতো ফুল-মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে। এই ঘটনাই নারী-নিরাপত্তা আর মেয়েদের সম্মানের প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথ সরকার তথা বিজেপির দ্বিচারিতা আরেকবার বে-আব্রু করে দিল। আইআইটির ওই ছাত্রী বি-টেক পড়ছিলেন। তাঁকে গণধর্ষণ করে বিজেপি আইটি সেলের তিন পদাধিকারী কুণাল পাণ্ডে, অভিষেক চৌহান ও সক্ষম পটেল। ঘটনার ঠিক পরেই এই তিনজনকে মধ্যপ্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিজেপির হয়ে ভোট-প্রচারে। সবচেয়ে বড় কথা গুজরাতে বিলকিস বানোর ধর্ষকরা জেল থেকে ছাড়া পেলে তাদের গলায় মালা পরায় বিজেপি। উন্নাও ও কাঠুয়াতে গণধর্ষণের পর ধর্ষকের সমর্থনে মিছিল বের করে তারা। আজ মমতা ব্যানার্জির সরকার আরজি কর ঘটনায় একজন অভিযুক্তেরও পাশে দাঁড়ায়নি।

আরও পড়ুন-বাংলার বঞ্চনা মানব না মানুষ এর উত্তর দেবে : মুখ্যমন্ত্রী

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই দ্রুত বিচার এবং কঠোরতম সাজার পক্ষে সওয়াল করেছেন। এখানেই বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের পার্থক্য। যে সংবাদমাধ্যম সকাল-বিকেল আরজি কর নিয়ে বাজারি গালগল্প ছড়াচ্ছে, তারা বিজেপির বেলায় মায়োপিক, চোখ বন্ধ থাকে তাদের। বিজেপি আরজি করের ঘটনার সুযোগে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। সাবধান!

Latest article