রাবাংলা থেকে বোরং পেরিয়ে ফামতাম প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। বোরং-এর রাস্তা বেশ খারাপ, কারণ বেশ কয়েকটা ঝরনা রাস্তার ওপর দিয়েই চলে গেছে আর এই অঞ্চলে বৃষ্টি একটু বেশি হয়। ফামতাম (Phamtam- South Sikkim) গ্রামের প্লে-গ্রাউন্ড পর্যন্ত গুগল ম্যাপে দেখা যায় তারপর ওখানকার মানুষজনই ভরসা। সবথেকে মজার ব্যাপার, এই গ্রামেই সাউথ সিকিমের মোটোরেবল রোড মানে গাড়ি-চলা রাস্তা শেষ। এই গ্রামের পর শেষ গ্রাম ‘সাদা’— কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর জন্য পায়ে-চলা পাহাড়ি পথই ভরসা।
রাস্তার ওপরেই হোম-স্টে। ছবির মতো সুন্দর, চারদিকে সবুজ পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, সামনে আকাশ জুড়ে মাউন্ট পান্ডিম দেখা যায়। রাস্তা থেকে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। ঘরগুলো খুবই সুন্দর ও সাজানো— সামনে বারান্দা। আর আছে একটা বড় বাগান, সেখানে নানারকমের পাহাড়ি ফুলগাছ। গাছের গুঁড়ি কেটে মজার মজার বসার জায়গা বানানো। আর আছে একটা দারুণ ট্রি-হাউস, যেখানে বসে খাওয়া, গল্পের বই পড়া, গল্প করা— যা ইচ্ছে করা যায়। মজার ব্যাপার হল, কাছাকাছির মধ্যে কোনও দোকান নেই। সকালের চা থেকে সারাদিনের খাবার পাওয়া যায় হোম-স্টেতেই। হোম-স্টের চত্বরের মধ্যেই কিচেন— যেখানে গ্যাস ওভেন, মাটির উনুন দুটোই আছে। ভাত, ডাল, বাগানের সবজি, ডিম, চিকেন ছাড়াও পাওয়া যায় দারুণ-দারুণ পাহাড়ি চাটনি। যেমন স্বাদ, তেমনি ঝাল— আমি নাম দিয়েছিলাম ‘আগ্নেয়গিরির চাটনি’! এ-ছাড়াও নানা সিকিমিজ রান্না, যেমন মোমো, মুলোর স্যুপ ইত্যাদিও খুবই টেস্টি। হোম-স্টের দিদিরা খুবই ভাল। আর সবথেকে ভাল হোম-স্টের কুকুর অলি। যে-ক’দিন আমরা ওখানে ছিলাম অলি সবসময় আমায় পাহারা দিত।
ফামতাম গ্রাম এত শান্ত, এত নির্জন যে রাস্তায় হাঁটলেও নিজের পায়ের শব্দ শোনা যায়। হোম-স্টে থেকে ট্রেক করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যায় বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী কিসিমখোলায়। ওখানেই রয়েছে বহু বছরের পুরনো লোহার ব্রিজও যেটা সাদা গ্রামের পথ। হোম-স্টের দিদিরাই রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গেল। কনকনে ঠান্ডা কিন্তু কাঁচের মতো পরিষ্কার জল কিসিমখোলায়। বেশ কয়েক ঘণ্টা যেন কোথা দিয়ে কেটে যায়।
ফামতাম (Phamtam- South Sikkim) থেকে গাড়ি করে ঘুরে আসা যায় বেশ কয়েকটি জায়গায়। ফামতামের পথেই পড়ে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম— বোরং। এখানে একটা হট স্প্রিংও আছে। আর যাওয়া যায় বিখ্যাত রোলং মনাস্ট্রি। রোলংয়ে দুটো মনাস্ট্রি। নতুনটায় মঙ্করা পড়াশোনা করে, হাতের কাজ করে। মনাস্ট্রির প্রার্থনাসভায় বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। আর এখানে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল ড্রাম ও শিঙা বাজিয়ে মঙ্কদের প্রার্থনা শোনা— দারুণ লাগে। পুরনো মনাস্ট্রিতে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ছাদ থেকে দেখা যায় পুরো রাবাংলা শহরটা। আরও দেখে নেওয়া যায় পাহাড়ের বুকে অর্ধেক ঝুলন্ত টাইটানিক ভিউপয়েন্ট। এই ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা যায় অনেক নিচে বয়ে চলা রঙ্গিত নদী আর ওপাশের পাহাড়ে বিখ্যাত তাশিডিঙ মনাস্ট্রি।
রাস্তায় পড়ে মজার ঝর্না Rambo ফলস। ঝর্নার ধারা গাড়িতে বসে দেখা যায় না, কিন্তু গাড়ির মাথায় ঝরঝর করে ঝরনার জল পড়ে। পাশেই রুদ্রগতিতে বয়ে চলা বার্মিলি খোলা। ব্রিজের ওপর থেকে দারুণ লাগে দেখতে। জলের আওয়াজে কথা শোনা যায় না। এ-ছাড়াও গাড়ি করে ঘুরে আসা যায় রাবাংলার বিখ্যাত বুদ্ধ পার্ক। এখানে রয়েছে প্রায় ১৩০ ফুট লম্বা বুদ্ধমূর্তি। রাবাংলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাউন্ট পান্ডিম ও আরও বেশ কয়েকটা পিক দারুণ দেখা যায়।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, জেনে রাখুন খুঁটিনাটি
সারাদিন গাড়ি করে ঘোরার পর বিকেলে ফিরে আসা শান্ত ফামতামে। ট্রি হাউসে বসে চা খেতে খেতে বসে সামনের পাহাড় আর মেঘের আসা-যাওয়া দেখা। হোম-স্টের পেছনেই একটা ছোট্ট চার্চ। ওখানে বসে চার্চের প্রার্থনাসংগীতও শোনা যায়।
একটা কথা বলে রাখা ভাল, বর্ষাকালে এখানে খুব জোঁকের উৎপাত। পুজোর ছুটিতে বেড়াতে গেলেও কভার্ড শ্যু পরাটা খুব জরুরি। আর জঙ্গলে ঘোরার সময় সঙ্গে রাখা দরকার নুন। যদিও ওখানে গিয়েই শিখলাম, যে স্যানিটাইজার দিয়েও দিব্য জোঁক ছাড়ানো যায়।
তোমরা যদি সত্যিই প্রকৃতিপ্রেমী হও আর নির্জন জায়গা ভালবাসো— তাহলে ফামতাম হতে পারে তোমার ছুটি কাটানোর মনপসন্দ জায়গা। তাহলে আর ভাবছ কী? বাড়ির সবাইকে নিয়ে এবারের পুজোর ছুটিতে কাটিয়ে যাও কয়েকটা দিন— সাউথ সিকিমের ফামতাম গ্রামে।
কীভাবে যাবেন?
ট্রেনে করে এনজেপি স্টেশন বা শিলিগুড়ি জংশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে চলে যাওয়া যায় ফামতাম। হোম-স্টেতে বললে ওরাও গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারে। শিলিগুড়ি থেকে সময় লাগে ৫ ঘণ্টার একটু বেশি। এ-ছাড়াও শেয়ার-জিপে করেও চলে যাওয়া যায় রাবাংলা। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ফামতাম। মনে রেখো, ফামতাম গ্রামে ঢোকার পর কিন্তু গুগল ম্যাপে রাস্তা শেষ। গ্রামের কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলেই পৌঁছে যাবে খালিংখিম হোম-স্টে।
কোথায় থাকবেন?
এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে একটাও হোটেল নেই। একটাই হোম-স্টে আছে, যেখানে আবার ঘর খুব বেশি নেই। সেজন্য একটু আগে থেকে বুকিং করতে হয়। হোম-স্টের নাম— খালিংখিম হোম-স্টে। তিন মেয়ে আর মা মিলে চালান। ফোনে বুকিং করা যায়। ফেসবুক পেজও আছে। সারাদিনের খাওয়াদাওয়া হোম-স্টেতেই। সাইটসিয়িংয়ের জন্য হোম-স্টেতে বললেই গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।