১৮৮০ সাল। তখন, সিপাহি বিদ্রোহোত্তর বাংলায় মেকলে মিনিটসের ধার ঘেঁষে ইংরাজি শিক্ষার বুনিয়াদ। সহমরণ প্রথার বীভত্সতা ও ব্রাহ্মণ্য ভন্ডামোর বিপরীতে ধিকি-ধিকি জ্বলছে আগুন। সমাজ শরীরে দানা বাঁধছে অবিচারের বিপরীতে ক্ষোভ। ঠিক সেই রকম একটা সময়, অবিভক্ত বাংলার রংপুরের মিঠাপুরে রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেন, রোকেয়া সাকোয়াত হোসেন। সাকোয়াত পদবীটি অবশ্য বিবাহসূত্রে পরবর্তীতে সংযোজন। জন্মসূত্রে নয়। বরং জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল কঠোর পর্দা প্রথা ও স্বাভাবিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমসাময়িক ইতিহাস। তবে, সে ইতিহাসের শালকাঠে কষ্টসাধ্য কারুকাজের মতো নিবিড় যত্নে গড়ে তুললেন রোকেয়া এক আশ্চর্য জীবনদর্শন। হ্যাঁ, দর্শন।
আরও পড়ুন-বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক
মামুলি নারীবাদের উপরচালাকি থেকে বহু যোজন দূরে গভীরতর তাঁর অবস্থান৷ রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের মশালটি তাঁর কাছে পৌঁছে কেবল বাইরে থেকে একটি আলোক বৃত্তই নির্মাণ করল না, সেই সঙ্গে চিনতে শেখাল আত্মনির্ভরশীলতার এতদিনের লুকোনো আয়াতগুলি। সেই মুহূর্তে মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব কর্মধারায় সে অভিঘাত অনভিপ্রেত হলেও, অপ্রয়োজনীয় বলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, ইতিহাস বলছে আঘাত বাইরে থেকে না এলে চাকবাঁধা অন্ধকার পুরুষতন্ত্রে কোনও দিন স্বচ্ছ উত্তরণের আলো এসে পড়তে পারে না। রোকেয়া সেই উত্তরণের চাকাটিকে ঘুরিয়ে দিলেন বীরদর্পে। অথচ, কাজটি সহজ ছিল না। বাবা জহিরুদ্দিন আবু হায়দার সাহেব ও মা রাহাতুন্নেসা চৌধুরীর অভিজাত পরিবারে কঠিন অনুশাসনে বড় হয়ে ওঠা রোকেয়ার শৈশবস্মৃতিতে তা স্পষ্ট। পরবর্তীতে, কলম ধরলে, ‘‘অবরোধবাসিনী” (১৯৩১)-র পরতে পরতে উঠে আসে সে সময়ের বিচ্ছিন্ন পারদ। একটি বিশেষ সময়ের ছবিকে, বলা ভাল, সে-সময়ে পর্দানশিন মুসলমান সমাজের নারীর জীবন ছবিটিকে বুঝে নিতে এতটুকু দেরি হয় না। সেকালে ভারতবর্ষে মুসলিম নারীদের উর্দু ও ফার্সি ছাড়া অন্য কোনও ভাষাশিক্ষার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। অথচ, রোকেয়া খাতুন, বাংলা ভাষা শিখেছিলেন নিজের মুনশিয়ানায়। আঠারো বছর বয়সে বিবাহ করেন বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনকে। এই সময় থেকেই ব্যক্তিজীবনে শিক্ষার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয় রোকেয়ার সামনে। তবে, এ কথা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই যে আন্তরিক আত্মশক্তির মোনাজাতটি হৃদয়তারের একতারাতে আজন্ম বিদ্ধ ছিল বলেই অনায়াসে রোকেয়া ছাপিয়ে যেতে পেরেছিলেন তাঁর সমকালের সমাজ ও সময়কে। আর, এখানেই তাঁর নিজস্ব দর্শনের কাঠামোটি সুঠাম। যাবতীয় বিলাস ও আরামের কাছে নতি স্বীকার না করে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার প্রাত্যহিক অনুশীলন। এ কাঠামোর ছায়াতেই রোকেয়ার নারীমুক্তির ভাবনা দানা বাঁধতে চেয়েছে গোটা মুসলমান সমাজের নারীজীবনে।
আরও পড়ুন-অসন্তোষ স্পষ্ট করে দিল কেন্দ্র
নারীর শিক্ষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট ভাবে বলছেন, ‘‘ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান ও ক্ষমতা দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। আমরা কেবল পাশ-করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।” সমমর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে যোগ্যতর হয়ে ওঠার উত্তর আধুনিক পদচিহ্নটি বোধ করি এখানেই নিহিত। পুরুষতান্ত্রিক অবয়বের চিরায়ত ভিতভূমে যে মৌলিক তীরটি ছুঁড়ে দিলেন রোকেয়া, তার ফলা নাড়িয়ে দিল পারিবারিক চিত্রনাট্য। নারী ও পুরুষের সম্পত্তিতে সম অধিকারের দাবি, শিক্ষা অর্জনের পাশে পাশে উপার্জনের প্রভূত প্রচেষ্টা এবং যাবতীয় যাপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বলিষ্ঠতাই যে একক নারী পরিচয়ের সমার্থক, তার সঠিক অনুধাবনটুকুই হয়ে উঠল প্রণিধানযোগ্য। আর এ বিপুল কর্মগোলকের ভরকেন্দ্রে অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠল রোকেয়ার একের পর এক যুক্তিনিষ্ঠ সাহিত্য আকর। যার প্রকাশ-ভাষা, বাংলা। আরবি, ফার্সি, উর্দু ছাড়াও ইংরেজি ভাষার ওপর প্রবল দখল থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন করলেন মুখের ভাষা। কারণ রোকেয়া জানতেন, যাঁদের জন্য তিনি সোচ্চার তাঁরা বাংলাভাষী। ‘‘সুলতানার স্বপ্ন” উপন্যাসের প্রকাশ কাল ১৯০৫। এ উপন্যাসে নারীর ভোটাধিকার ও আদালতে সাক্ষী দেওয়ার অধিকারকে সামনে এনেছেন রোকেয়া। আশ্চর্য এই যে, কেবল পরাধীন ভারতবর্ষ নয়। শাসক দেশ ইংল্যান্ডে তখনও নারীর পূর্ণ ভোটাধিকার আসেনি। রোকেয়া কল্পনার দাবিতে উপন্যাসের চরিত্রে মিশিয়ে দিলেন নিঃশর্ত নারী স্বাধীনতার নির্মেদ আত্মঘোষণা। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতায় তুলে ধরলেন, নারী শিক্ষার মূল উপজীব্য।
১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সাখোয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের যাত্রা শুরু হলে নারী মননের সার্বিক মুক্তি আলো সন্ধানী ঋজু কলমটির মতোই দৃঢ় বিশ্বাসের রেশটুকু সমাজে মননে। তাঁর সৃষ্টিতে ইউটোপিয়া ও ডিস্টোপিয়ার যুগল প্রয়োগে, নারীতন্ত্রের সাধনরীতিটি বারবার স্বীকৃত। ‘পদ্মরাগ’— এ যে আস্ফালন, তা ‘বোরখা’য় নেই। তবে কি পুরুষতন্ত্রকে অস্বীকার করেও কখনও কখনও রোকেয়া আপস করেছেন তার সঙ্গে? এই আধুনিক দ্বন্দ্বটি বেগম রোকেয়াকে ঘিরে থাকলেও সময়কালকে আত্তীকরণ করে আগামীর জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া নবজাগরণের জায়মান আগুনটিকে ভুলে থাকার হিম্মত দেশ ও কালের কখনও হওয়ার নয়।