অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী, মোদিকে সতর্ককারী ত্রয়ী

ব্যাঙ্কিং-ব্যবস্থা ভেঙে পড়া একমাত্র রোধ করা সম্ভব সরকারি আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে। এই সত্যটি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন ২০২২ সালের ৩ জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। এটি নিঃসন্দেহে মোদি-সরকারের ওপর চরম সতর্কতা! মোদি-সরকার যেভাবে সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাতে কি আদৌ দেশের ব্যাঙ্কিং-ব্যবস্থা বাঁচবে? লিখছেন অর্থনীতিবিদ দেবনারায়ণ সরকার

Must read

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়া একমাত্র রোধ করা সম্ভব সরকারি আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে। এই সত্যটি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন ২০২২ সালের ৩ জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। এটি নিঃসন্দেহে মোদি-সরকারের ওপর চরম সতর্কতা!
এ-বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন বেন বার্নান, ডগলাস ডায়মন্ড এবং ফিলিপ ডিগভিক (Ben Bernanke- Douglas Diamond- Philip Dybvig)। সুইডেনের নোবেল কমিটি জানিয়েছে, এ-বছর অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে নোবেল প্রাপক হিসাবে এই ৩ জনকে (Ben Bernanke- Douglas Diamond- Philip Dybvig) বেছে নেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্কিং অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে গবেষণা করার জন্য। এই তিনজনই মার্কিন নাগরিক। ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক ৬৮ বছরের বার্নান। শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডায়মন্ড। ৬৭ বছরের ফিলিপ গবেষণা করেন সেন্ট লুইসের ওলিন বিজনেস স্কুল ওফ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে।

ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার গুজবে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে এবং তার প্রভাব কীভাবে কমানো যায়, সেই নিয়েই গবেষণা করেছেন তাঁরা। ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার গুজব ছড়ানোর পর জমাকৃত টাকা তোলবার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় গ্রাহকরা। এর ফলে ব্যাঙ্ক ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তাদের টাকার গ্যারান্টি বিমার মাধ্যমে সরকার দিলে এই অবস্থা তৈরি হয় না। এই গবেষণার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল অর্থব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকারকে দায়বদ্ধ থাকতেই হবে।

সাম্প্রতিককালে ভারতেও বহু ব্যাঙ্কে তালা পড়েছে— বিশেষ করে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ হওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে লাখো লাখো গ্রাহকের। এর পরিণতিতেও মার্কিন অর্থনীতিবিদদের এই গবেষণা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ভারতের।
গত সোমবার সুইডেনের নোবেল কমিটির তরফে ২০২২ সালের অর্থনীতিতে এঁদের নাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘‘অর্থনীতিতে ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা বিশেষত আর্থিক সঙ্কটের সময় বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের কার্যকলাপ অনুধাবন করতে এই ত্রয়ী গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।”
পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান টোরে এলিংসেন বলেছেন, ‘বিজয়ীদের অন্তদৃষ্টি গুরুতর সঙ্কট এবং ব্যয়বহুল বেলআউট উভয় এড়াতে আমাদের ক্ষমতাকে উন্নত করেছে।’ আশির দশক থেকে তাঁরা এই বিষয় নিয়ে কাজ করছিল।

আরও পড়ুন-মার্কিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন: মোদির ভারতে ধ্বংস হয়েছে আইনের শাসন

বিখ্যাত অর্থনীতির জার্নাল journal of political economy, vol.91, no.3, ‘‘Bank runs, deposit insurance and liquidity” নিবন্ধে অর্থনীতিবিদ ডগলাস ডায়মন্ড এবং ফিলিপ বিগভিক তাত্ত্বিক মডেল তৈরি করে ব্যাঙ্কগুলির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। দেখিয়েছেন সমাজে তাদের ভূমিকা এবং পতন সম্পর্কে গুজব তৈরি করে আর কীভাবে সমাজ এই দুর্বলতা কমাতে পারে।
ওই একই বছরে (১৯৮৩) বিখ্যাত the American economic review, vol.73, no.3, ‘Non-monetary effects of the financial crisis in the propagation of the great depression’ নিবন্ধে বেন বার্নান আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অর্থনীতির সঙ্কট হিসেবে ১৯২৯-’৩৩ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন বিশ্লেষণ করেছেন এবং কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব তাঁর দিকনির্দেশ করেছেন।
তাঁদের উভয়ের গবেষণায় ব্যাঙ্কের ভূমিকা স্পষ্ট হয়েছে সঙ্কটের সময় এবং তাঁদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান হল, কেন ব্যাঙ্কের পতন এড়ানো জরুরি?

তাঁদের গবেষণা অর্থনীতিক বিজ্ঞানে সমাজের জন্য, গুরুতর পরিণতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করবে। এই গবেষণা আমাদের সকলের জন্য অনেক উপকারী।
এই ত্রয়ীর কাছ থেকে যা প্রধান শিক্ষার তা হল, ব্যাঙ্কগুলোকে সঙ্কটের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে। ব্যাঙ্ক অমানতের গ্যারেন্টর হতে হবে। অথচ ভারতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার নির্দেশিত পথে নয়া উদারবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির জাঁতাকলে বর্তমান সরকারের আমলে অতি দ্রুত সরকারি ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারীকরণ হচ্ছে। ব্যাঙ্কের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যরক্ষার্থে বহু ব্যাঙ্কের সংযুক্তকরণ হয়েছে। এরপর সরকার থেকে আরও বলা হচ্ছে, ব্যাঙ্ক-ব্যবসা থেকে সরকার দ্রুত হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। এটা ঘটনা যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা সারা দেশে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, গ্রামের মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ইত্যাদি নানাবিধ জনমুখী প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বর্তমানে মোদি সরকার এক-দুটো ব্যাঙ্ক বাদে বাকি ব্যাঙ্কের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত ঘোষণা করেছে সরকার, তখন এই তিন অর্থনীতিবিদের নোবেল জয়, সুস্পষ্ট দিক নির্দেশ করল যে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি যখন তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হবে, তখন সরকারকেই অর্থের ডালি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নচেৎ সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। ব্যাঙ্কের পতন ঘটবে। আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ ফেরত পাবেন না। এই পরিস্থিতিতে সরকার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সর্বভৌমত্ব নিয়ে চরম বিপদ দেখা দিতে পারে। বর্তমান সরকারের তা বোঝা উচিত।

সাম্প্রতিককালে একটা অভিজ্ঞতা নিশ্চয় সরকারের হয়েছে। সেটা হল, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের এবং কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষার্থে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি অপরিশোধিত ঋণ মেটাতে গিয়ে ব্যাঙ্ক সাধারণ অমানতকারীদের স্বল্প সঞ্চয়ের সুদ হ্রাস করেছে। যার বিষাক্ত ফল ভুগছেন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক পরিবারগুলি। সুদের হার চরম হ্রাস পাওয়ায় আজ তাদের চরম দুর্দিনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও স্বেচ্ছাচারী মোদি সরকার যেভাবে সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাতে কি আদৌ দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা বাঁচবে?
এমতাবস্থায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘জনযুদ্ধের গান’ কবিতার দুটি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক— ‘‘জনগণ হও আজ উদ্বুদ্ধ/ গড়ে তোল প্রতিরোধ জনযুদ্ধ।”

Latest article