ভরা বর্ষাতেই গোটা বাংলা জুড়ে যেন শারদোৎসবের অকালবোধন। দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে ইচ্ছেপূরণের উদযাপন। বঙ্গহৃদয়ের ক্যানভাসে আবারও প্রাপ্তির এক নতুন রং। এ যেন আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানির বিভেদ ধুয়ে মুছে সাফ হওয়ার মরশুম। শাসিত এবং শোষিতের মাঝের কাঁচের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়ার চোদ্দতম বর্ষে এসে শাসক ও শাসিতের মিলেমিশে এক হওয়ার দিন। আমজনতাকে আজ আর ব্যালট বাক্সের নীল ছাপে নয়, বরং চেনা যায় তাদের দাবিদাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার এই ধরনের ছকভাঙার সাহস দেখাল পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে গণতন্ত্রকে ভোটসংখ্যার পরিবর্তে মাপা হচ্ছে মনুষ্যত্বের এককে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জ্বালানিরূপে নিজেকে নিঃশেষিত করে উদ্বায়ী ধোঁয়ার পরিণত হওয়ার চিরাচরিত প্রথায় যবনিকা নামাল এই বাংলাই।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষই এখন শাসনতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পদাধিকারীর পদলেহনের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিষ্ঠানকে দুরমুশ করে নিজের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার এক ব্যতিক্রমী আলোকবর্তিতার পথে পা বাড়াল বাংলা। এ যেন ‘আপনার সরকার, আপনার অধিকার।’ বাংলার ভোটারদের ট্যাক্সের টাকা খরচের রুটম্যাপ এবার নির্ধারিত হবে তাদেরই সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। সরকার থাকবে কেবল নির্বাক শ্রোতার ভূমিকায়।
আরও পড়ুন-রাজস্থানে ট্রাকের সাথে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মৃত ৭ শিশু সহ ১০
আমজনতার আজ্ঞাবহ হয়ে বাস্তবায়িত করবে সম্মিলিত জনাদেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক প্রহসনের কাঁচের খাঁচায় প্রথম আঘাত হেনেছিলেন যে বীরাত্মা, গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণের সাজানো বাংলায় সর্বোত্তম ঝাড়বাতিটাও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মাসে আপনার পাড়ায় জ্বালিয়ে দিলেন তিনি-ই ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান।’ প্রজাকল্যাণের রথ এবার এগোবে রাজা নয় বরং প্রজার ইচ্ছায়। বিমাতৃসুলভ রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক বৈষম্যকরণের প্রথাগত অভ্যাসে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বাংলার প্রাপ্য ১.৭৫ লক্ষ কোটি বকেয়া টাকা আটকে রাখার পরও ২০১১ পরবর্তী বাংলার নবজাগরণের মুকুটে গত ২২ জুলাই সংযুক্ত হল আস্থার আরও একটি উজ্জ্বল পালক যেখানে পশ্চিমবঙ্গের ৮০ হাজারেরও বেশি বুথের প্রতিটিতে দশ লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ করা হল সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া মেটানোর জনহিতকর সংকল্পে।
প্রায় ৮০০০ কোটি টাকার রাজসূয় যজ্ঞে পুরোহিতের দায়িত্ব সামলানোর গুরুভার থাকছে মুখ্যমন্ত্রী নয়, বরং আম-আদমির কাঁধেই। সেচ, বিদ্যুৎ, পূর্ত, জনস্বাস্থ্য, কারিগরি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা-সহ অতিপ্রয়োজনীয় ১৬টি ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিক নির্ধারণ করবে তাদের আঞ্চলিক সমস্যা ও তার আশু সমাধান। ২ অগাস্ট থেকে ৩ নভেম্বর অবধি সময়কালে পাড়ায় পাড়ায় রাজ্য জুড়ে থাকবে সাতাশ হাজারেরও বেশি ক্যাম্প যেখানে প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে নিজেদের এলাকার সমস্যার কথা লিপিবদ্ধ করবেন বঙ্গবাসী। সমস্যার গভীরতা মূল্যায়ন করে নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে শুরু হবে কাজ এবং বাধ্যতামূলকভাবে সরকার তা শেষ করবে আগামী বছর জানুয়ারির ১৫ তারিখের আগেই।
প্রকল্পের অগ্রগতি ও বরাদ্দ অর্থের ব্যয়কেন্দ্রিক স্বচ্ছতার নিরীক্ষণও এক্ষেত্রে থাকছে জনতার হাতের মুঠোয়। apas.wb.gov.in-এ ক্লিক করলেই মিলবে যাবতীয় আপডেট। নিকাশিক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এলাকা জুড়ে চলবে নর্দমা ঢাকার বন্দোবস্ত, সোক পিট ও কালভার্ট নির্মাণ। টিউবওয়েল, জলের পাইপ, জলের ট্যাঙ্ক ও পানীয় জলের সরবরাহকেন্দ্রিক যাবতীয় সমস্যার সমাধানও থাকছে সরকারের অবশ্য পালনীয় তালিকায়। এলইডি আলো ও সোলার আলোয় মুড়ে ফেলা হবে গোটা বাংলাকে। বাজার এলাকায় শৌচালয় তৈরিকেও ভাবা হচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে।
আরও পড়ুন-নয়া প্রযুক্তিতে বিপত্তি, চিঠির পাহাড় পোস্ট অফিসে
শিশুদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের লক্ষ্যকে সামনে রেখে তালিকায় স্থান পেয়েছে আইসিডিএস কেন্দ্রের মানোন্নয়নও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের শৌচালয় ও পানীয় জলের সরবরাহকেন্দ্রিক যাবতীয় অভিযোগের সমাধানে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার। এলাকাভিত্তিক পুকুর খনন ও ঘাট বাঁধানোও রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনার তালিকায়। প্রতিটি জনবহুল এলাকায় তৈরি হবে ডাস্টবিন। খোলা জায়গায় জনতার সুবিধায় বেঞ্চ, শেড নির্মাণেও দৃঢ়সংকল্প মা-মাটি-মানুষের সরকার। সবজি ও মাছের বাজারগুলিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনাকেও দেওয়া হচ্ছে বিশেষ প্রাধান্য। সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বাংলার প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে ছোট কমিউনিটি সেন্টার তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবার সময়ের অপেক্ষামাত্র। বাসস্টপে শেডের ব্যবস্থা থেকে অটো/রিকশা স্ট্যান্ড, ফুটপাথ কিংবা ফুটব্রিজ— যাত্রী যাতায়াতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনে নির্দ্বিধায় দিন গোনা শুরু করতে পারেন রাজ্যবাসী। এলাকার ছোট পার্কগুলির সার্বিক উন্নতিকল্পে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি বিদ্যুৎ এবং রাস্তা সংক্রান্ত যাবতীয় আক্ষেপও আগামী পাঁচ মাসে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার। সবটাই হবে জনতা-জনার্দনের ঐক্যবদ্ধ জনমতের ওপর ভিত্তি করে। বাড়তি পাওনা একই সাথে “দুয়ারে সরকার” প্রকল্প। তাই আগামীর বাংলা সততই যেন “সব পেয়েছির দেশ”।
প্রাপ্য সরকারি সহায়তা আদায়ে জুতোর শুকতলা খোয়ানোর চৌত্রিশ বছরের সিপিএমীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত বাঙালির স্বতন্ত্রতার এই নতুন সূর্যোদয়ের সর্বাধিনায়িকার চিরস্মরণীয় নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আদতে জনাদেশে নির্বাচিত হওয়া অনেকটা যেন ঋণগ্রহণের সমতুল্য— যেখানে কোনও এক গ্রীষ্মের দুপুরে জনগণের উপহার দেওয়া ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের ঋণ আগামী পাঁচ বছরে পরিশোধ করতে হয় সেবাব্রতের সুদে-আসলে।
আরও পড়ুন-আজ দল নামাবে না মোহনবাগান
আমজনতাকে গণতন্ত্রের চালিকাশক্তিরূপে অধিষ্ঠিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থার এক অকুণ্ঠ সিংহদুয়ার; স্মরণ করিয়ে দিলেন যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ যথার্থই সাধারণতন্ত্রের ভৃত্যমাত্র, জনাদেশের কাঠের পুতুল। কালীঘাটের টালির চালা থেকে উঠে আসা মেয়েটা ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছানোর পরও ভুলতে পারেনি তার আটপৌরে শিকড়কে। তার রাজধর্মের পুরোটা জুড়েই রয়েছে ন্যায়ধর্মের সার্থক অনুশীলন যেখানে রাজ্য জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্যের চূড়ায় বিরাজ করার পরও নির্দ্বিধায় ক্ষমতার অকুণ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ চলে আমজনতার মধ্যে। স্বৈরাচারিতা প্রতিস্থাপিত হয় সহমর্মিতায়। তাই তো গোটা বাংলা জুড়ে আওয়াজ ওঠে ‘— তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো, ছেড়ে দেবো না!’