ফের একবার ২০১৪-এর লোকসভা ভোটে বাংলার মানুষের থাপ্পড় খেল বিজেপি। তাদের ৩৫ আসন পাবার উদগ্র দাবি ফুরিয়ে গেল মাত্রই ১২ আসনে পৌঁছে। তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি আসন পেল এবং একাধিক আসনে অল্পের জন্য জয় পেল না মূলত বাম-কংগ্রেস জোট তাদের ভোট-বাক্সে থাবা বসাল বলেই। দক্ষিণবঙ্গের একাধিক আসনে অবশ্য নির্বাচনের দিন বুথে বুথে তাণ্ডব চালিয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে বিজেপির ভৈরব বাহিনী ব্যাপক রিগিং চালিয়েছে তমলুক ও কাঁথি আসনে। এত কিছু করেও তারা বাংলা থেকে সিট বাড়াতে পারেনি এইবার, উলটে তাদের আসনসংখ্যা বিগত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত সংখ্যা থেকে অনেকটা কমেছে। গোটা দেশ এই ভোটে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সার্বিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের ‘আব কি বার ৪০০ পার’ স্লোগান মুখ থুবড়ে পড়েছে ২৪০ আসনে এসে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে থমকে যেতে হয়েছে তাদের।
আরও পড়ুন-মেলেনি ১০০ দিনের টাকা ক্ষোভে পোড়ান হল মোদির কুশপুতুল
কিন্তু বাংলায় এই ব্যর্থতার পরেই বিজেপি এবং বামেরা যৌথভাবে সামাজিক মাধ্যম-সহ সর্বত্র চিল-চিৎকার জুড়ে দিয়েছে এবং বাংলার মানুষকে ‘ভিখারি’, ‘ভাতাজীবী’ ইত্যাদি কুৎসিত বিশেষণে ভূষিত করেই চলেছে। এদের প্রধানতম টার্গেট বাংলার নারীসমাজ, যাঁদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো একটি অভূতপূর্ব সামাজিক প্রকল্প চালু করেছেন এবং যার দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন প্রায় আড়াই কোটি বঙ্গনারী। এই সামগ্রিক নারীসমাজকে রাম-বাম সম্প্রদায় ‘মাত্র ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে’ বলে গালি দিয়ে চলেছে। তারা বুঝতেই পারছে না, বাংলার মেয়েদের এই অপমান করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টাই বাংলার ক্ষমতা থেকে তাদের দূরে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। আর ঠিক এই জায়গাতেই ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্যা। তিনি বাংলার মেয়েদের সশক্তীকরণের কাজে একের পর এক প্রকল্প নিয়েই চলেছেন। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপ’ থেকে আরম্ভ করে বিধবা ভাতা অব্দি এরকম অনেক প্রকল্পেরই নাম করা যায়, যেগুলো মেয়েদের লক্ষ্য করেই চালু হয়েছে। এখানেই সমস্যা হচ্ছে রাম এবং বামেদের। কারণ এই দুটো দলই প্রবল পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক এবং এদের মুখোশ খুলে গেলেই প্রকট নারী-বিদ্বেষী চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে। যে-কারণে, তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের ৩৮% মহিলা আর বিজেপির প্রার্থীদের মধ্যে মাত্রই ১২% নারী। সিপিআইএম পার্টির পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে মহিলা-সদস্য আজও দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে হারাতে হত আরও ১৪ আসন, মায়াবলে অস্তিত্বরক্ষা বিজেপির
কিন্তু বাংলা শক্তিপীঠ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় শক্তির প্রকাশ নারীতে, যার ভিতরে আছে সৃষ্টির ক্ষমতা। প্রজননের ক্ষমতা তাকে দিয়েছে দেবিত্ব, আবার মানবকুলে তিনি মাতৃকাশক্তি। তিনিই এই সৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। একদিকে অশুভ শক্তির বিনাশে তিনিই অগ্রগামিনী আবার পুরুষের কর্মশক্তিকে জাগরিত ও উৎসাহিত করার ক্ষমতার অধিকারিণী রূপে পুরুষদেবতার স্ত্রীই তাঁর শক্তি। মহাদেব শিবের শক্তি মহাদেবীকে আদিশক্তির মূর্ত প্রকাশ ও পরমাপ্রকৃতি জ্ঞানে পূজা করেন শাক্ত সম্প্রদায়। তিনিই সকল দৈব, জাগতিক ও মহাজাগতিক কর্মশক্তির আধার এবং বিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
বাংলা সাহিত্যের শাক্ত পদাবলি ধারায় এই শক্তির দেবী বিভিন্ন রূপে মূর্ত হয়েছেন। শক্তির দেবী কখনও কবির চোখে মেয়ে রূপে, কখনও মা রূপে প্রতিভাত হয়েছেন। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের কবিতায় মাতা মেনকা বাৎসল্যভাবে দেবীকে কন্যা উমা রূপে কল্পনা করেছেন—
গিরিবর আর আমি পারিনে হে; প্রবোধ দিতে উমারে
উমা কেঁদে করে অভিমান, নাহি করে স্তন্যপান,
নাহি খায় ক্ষীর ননী সরে…
কাঁদিয়ে ফুলালে আঁখি, মলিন ও মুখ দেখি,
মায়ে ইহা সহিতে কি পারে?
কিন্তু এই উমা নিছক মেয়ে নন, জগজ্জননী। মহামায়াই কন্যারূপ ধারণ করে লীলা বিস্তার করছেন। রামপ্রসাদের ভাষায় :
জগৎ-জননী যার ঘরে।
কহিতে কহিতে কথা, সুনিদ্রিতা জগন্মাতা,
শোয়াইলে পালঙ্ক উপরে।।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গি সংক্রমণ একগুচ্ছ পদক্ষেপ হাওড়া পুরসভার
‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’ পর্যায়ের গানে এই বাৎসল্যের আকুলতা যেরকম বাধাহীন রূপে ধরা দিয়েছে, সেরকমই দেবীর ঐশ্বর্যভাবও ধরা পড়েছে কমলাকান্তের কবিতায়— “ও পদ পঙ্কজ লাগি, শঙ্কর হৈয়াছে যোগী গো/ হর হৃদি মাঝে রাখ অতি যতনে”। আর এই সামগ্রিক ভাব-আকুলতাই ধরা পড়েছে বাঙালির চিরন্তন গার্হস্থ্য রসের আঙিনায়। বাংলায় মেয়েদের যে সম্মান আবহমানকাল ধরে চলে এসেছে, তার মূল লুকিয়ে আছে এই শক্তি-সাধনার ভিতরে। আমাদের জাতিসত্তার গভীরে শাক্ত-ভক্তির এই শিকড় এতটা গভীর বলেই বাংলার গণমানুষের হৃদয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে এই বিপুল আবেগ কাজ করে। বাঙালি জনসমাজ তাঁকে অন্নপূর্ণা রূপে, গোটা জাতির বরাভয় প্রদানকারী নেত্রী রূপে মানে। আমাদের সমাজে মেয়েদের এই সম্মানের জায়গা অমলিন বলেই মহিলাদের জন্য তৃণমূল সরকারের এতগুলি প্রকল্প বাংলার মানুষের কাছে এতটা গ্রহণযোগ্য। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ কোনও ভিক্ষা নয়, তা বাঙালি অস্মিতার প্রতীক।
হিন্দিবলয়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে আসা বহিরাগত বিজেপি নেতাদের মগজে বাঙালির এই জাতিগত ভাবকল্প ও বিগ্রহের অর্থ কখনওই ঢুকবে না। তাই এই বাংলায় তাদের ঠাঁই নেই।