গ্রামীণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এগোচ্ছে বাংলা

কন্যাশ্রী এখন বিশ্বশ্রী। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, পথশ্রী থেকে যুবশ্রী, প্রতিটি প্রকল্প মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। দেশের বাইরে বিদেশেও সমাদৃত। লিখছেন ড. রূপক কর্মকার

Must read

ভারতের জনসংখ্যার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের কাছে তাদের জীবনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার সামর্থ্যটুকু থাকে না। এই ধরনের মানুষের কাছে সামাজিক প্রকল্প জীবনদায়ী ওষুধের মতো কাজ করে। ২০০৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার জীবনদায়ী ওষুধের মতো কাজ করা প্রকল্প মনরেগা (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন) এর প্রবর্তন যুগান্তকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৫ সালে এনরেগা (ন্যাশলাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি আইন) হিসেবে আইনটি পাশ হলেও ২০০৬ সালে তার পূর্ণতা পায় জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধীর নামানুসারে।

আরও পড়ুন-চিনকে রুখতে অতীতের শত্রুতা ভুলে একজোট হচ্ছে আমেরিকা ও জাপান

এই প্রকল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার জন্য ন্যূনতম কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। দূরদূরান্তে গ্রামগুলির মানুষের কাছে বেঁচে থাকার যেন রসদ ছিল এই প্রকল্পটি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ দেওয়া সরকারের দয়া নয়, বরং গরিব খেটে খাওয়া মানুষের পরিবারগুলি সরকারের কাছে দাবি করতে পারে এবং তাদের পরিশ্রমের বদলে বেতন পেতে পারে। এই প্রকল্পের একমাত্র লক্ষ্য বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কাজ দেওয়া। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১০০ দিনের কাজ হলেও গরিব আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো ৩৬৫ দিন এই আশায় বাঁচত যে সরকার তাদের অধিকারের ১০০ দিন কাজ দেবে। মনরেগার প্রধান উদ্দেশ্য শুধু ১০০ দিনের কাজ নয়, উৎপাদনশীল সম্পদ তৈরি করে জীবিকা সংস্থানের ভিত্তি বৃদ্ধি করা, সাধারণ মানুষকে আরও সক্রিয়ভাবে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ঘটানো এছাড়া পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণ। মনরেগা প্রকল্পের অধীনে কিছু এনটাইটেলমেন্ট থাকলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো কোনওক্রমে সেটা ভুলে গেছে বা কোনও এক অদৃশ্য শক্তি তাদের ভোলানোর চেষ্টা করছে। কিছু স্মরণীয় এনটাইটেলমেন্ট যেমন, জব কার্ডের অধিকার, ১৫ দিনের মধ্যে জব কার্ডে কাজের অধিকার, কাজ করার ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি পাওয়ার অধিকার। যখন সব কিছুই খাতায়-কলমে লিপিবদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বড় পদক্ষেপ ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প।

আরও পড়ুন-ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার ভয়েই ইস্তফা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর

অলীক দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে, দিনের পর দিন নানারকম কেন্দ্রীয় টিম পাঠিয়েও যখন কোনও উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি, তখন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ডায়মন্ড হারবার লোকসভার মাননীয় সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সমস্ত সাংসদ দিনের পর দিন ধরনা বা এই দফতর থেকে সে দফতর ছুটে ও পশ্চিমবঙ্গের গরিব সাধারণ মানুষের জন্য মনরেগার বকেয়া টাকা ফেরত আনতে পারেননি। তবে ভবিষ্যতে আন্দোলনের যে জয় হবে সেটা যুব সমাজের আইকন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অচিরেই বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু মা-মাটি-মানুষের সরকারের যে কমিটমেন্ট, গরিব মানুষগুলোকে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা তার জন্য বড় পদক্ষেপ ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প। ওই যে কথায় আছে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, সেই উপায় বাতলে দিলেন ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভাবের সংসারে কীভাবে মানুষের পরিবারকে সচ্ছল রাখা যায় সেটার পথই হল‍‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প। একটু সুখের আশায় সারাজীবন আমরা কষ্ট করে যাই। আর ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনবেন সেটাই তো বাস্তব। গরিবের প্রকৃত বন্ধু যে আছে সেটা আমরা হয়তো ভুলে গেছি। আসলে যেই মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে বসে নিজের ছেঁড়া জুতো সেফটিপিন দিয়ে ঠিক করে আবার সেটি ব্যবহার করতে পারেন, এবং নিজের শীতবস্ত্রটি ছিঁড়ে যাওয়ার ফলে সেফটিপিন দিয়ে জোড়া দিয়ে পরিধান করতে পারেন তাঁর কাছে এক-একটি টাকার মূল্য কতটা সেটা বলে বোঝানোর প্রয়োজন মনে হয় পড়বে না। সরকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী ৫০-৬০ দিনের কর্মদিবস তৈরি করল যাতে অভাবী সংসারগুলো সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের সরকার ১০০ দিনের কাজে কর্মদিবস বাড়িয়ে নজির সৃষ্টি করেছিল। ১০০ দিনের কাজ যতই অদক্ষ শ্রমিকরা করুক না কেন, দীর্ঘদিন কেউ একই কাজের মধ্যে থাকলে তারা কেবল দক্ষই হয় না, অভিজ্ঞতাও বৃদ্ধি পায়। গ্রামের রাস্তা তৈরি, বাঁধ নির্মাণ, পুকুর খনন ইত্যাদি তৈরিতে সেই অদক্ষ হাতই দক্ষ হয়ে পশ্চিমবঙ্গকে সাফ্যলের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ দ্বারা বাস্তবায়িত বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে একটি আর্থিক বছরে জব কার্ডধারী পরিবারকে কমপক্ষে ৫০ দিনের মজুরির কর্মসংস্থান করা। মনরেগার বকেয়া মেটানোর জন্য রাজ্য সরকার ৩৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে এবং পাওনা মিটিয়েছে। ইতিমধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ এই কর্মশ্রী প্রকল্পে কাজ পেয়েছে তাতে ৫ কোটির বেশি কর্মদিবস তৈরি হয়েছে। অদক্ষ শ্রমিককে দক্ষ তৈরি করতে ইতিমধ্যে ১০ লাখ যুবক-যুবতীকে বিনামূল্যে স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। শহরের আর্থিক সমৃদ্ধি নির্ভর করে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে। দক্ষ শ্রমিকের তৈরি কাজ শহরাঞ্চলের বুনিয়াদ মজবুত করবে এটাই বাস্তব।

আরও পড়ুন-আজ বিধানসভার অধিবেশন শুরু

‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু ৫০ দিনের কাজ দেওয়া হবে তাই নয়। বিভিন্ন কর্মতীর্থের মাধ্যমে বিনামূল্যে দোকান দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সারাবছর রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী মনরেগা প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সেরার সেরা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক কোটি মানুষেরও বেশি যা অন্যান্য রাজ্য থেকে অনেকটাই এগিয়ে। কর্মদিবস তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ নজির সৃষ্টি করেছিল, তারপরও এই প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ শূন্য। কিন্তু এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নামটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর মস্তিকপ্রসূত ‘কন্যাশ্রী’ এখন বিশ্বশ্রী। ‘পথশ্রী’ প্রকল্প হোক বা ‘যুবশ্রী’ প্রকল্প, প্রত্যেকটি প্রকল্প মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। প্রকল্পগুলি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে শুধু তাই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সমাদৃত হয়েছে। তার ফলস্বরূপ বাংলার একের পর এক প্রকল্পের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুকরণ, সে ‘কন্যাশ্রী’ হোক বা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা বর্তমানে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, আগামী দিনেও যে বাংলা পথ দেখাবে তা অনুমেয়। ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প আরও একটি প্রকল্প যা অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বসম্মানে ভূষিত হবে তা বলাই বাহুল্য।

Latest article