সংহত ভারত-চিহ্নের ধাত্রী এখন বাংলা

জনবিস্ফোরণ, বেকারত্ব, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা— এই সবকিছুর মোকাবিলায় নিজের সার্থকতা প্রতিপন্ন করেছে বাংলা। আর মা-মাটি-মানুষের সরকার সেকাজ করেছে স্বামী বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথে। জনকল্যাণ, কর্মসংস্থান আর ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা রোপণ হয়ে চলেছে প্রতি নিয়ত রাজ্যের কোনায় কোনায়। লিখছেন বারাসত কলেজের অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

ভারতবর্ষের মতো সার্বভৌম দেশে প্রধান দুটি সমস্যা হল জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং বেকারত্ব। এই দুটি সমস্যা সমাধানের রাস্তা নির্বাচিত সরকারের হাতেই ন্যস্ত। কিন্তু বর্তমানে উপরিউক্ত সমস্যার সঙ্গে আরও একটি সমস্যা যুক্ত হয়েছে, তা হল ধর্মের জিগির। যা শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার পিছনে অন্যতম কারণ কিন্তু সাম্যের অভাব। অনুন্নত দেশগুলোতে এই ধর্মের মেরুকরণ কিন্তু স্বভাবতই বেশি। যে-সমস্ত রাষ্ট্রে মানুষের সমানাধিকার নেই সেইখানে ধর্মীয় জিগির বেশি। এই সময়ের সন্ধিক্ষণে ধর্মীয় গুণের আত্মচেতনায় মহৎপ্রাণ স্বামী বিবেকানন্দের অভাব বড্ড অনুভূত হয়। আধুনিক বিশ্বে স্বামী বিবেকানন্দের উল্লেখযোগ্য অবদান হল ধর্মের ব্যাখ্যা ও তার সর্বজনীনতা। তিনি এমন এক ধর্মের কথা বলেছিলেন যা সমস্ত মানবতার জন্য সাধারণ। তার প্রচলিত চেতনায় ধর্ম ও বিজ্ঞান একে অপরের বিপরীত নয় বরং পরিপূরক। আধুনিক সমাজে অনৈতিকতা, হিংসা, অপরাধের ফলে মানুষের যে অবক্ষয় চলছে, সেখান থেকে একমাত্র মুক্তির রাস্তা আত্মার সম্ভাব্য দেবত্বের যা মানবিক সম্পর্কের উন্নতিসাধন করে, অবক্ষয় রোধ করে এবং জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।

তৎকালীন সময়ে অন্বেষণের দীর্ঘযাত্রা শুরু করার পর স্বামীজি ভারতবর্ষের জনসাধারণের ভয়াবহ দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবক্ষয় স্বচক্ষে উপলব্ধি করেছিলেন। বিশ্বের প্রথম কোনও মনীষী ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারতের পতনের অন্যতম কারণ জনসাধারণের অবহেলা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও জনসাধারণ কীভাবে ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছে সেটাই ছিল স্বামীজির কাছে আশ্চর্যের। স্বামীজি তৎকালীন সময়ে উপলব্ধি করেছিলেন জনসাধারণকে দারিদ্র্যের কুসংস্কার এবং ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে টেনে বের করার জন্য দুই ধরনের জ্ঞানের আব্যশিকতা রয়েছে, প্রথমত, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জ্ঞান এবং নিজেদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান। সেইজন্য তৎকালীন সময়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণমুখী কাজ করা। স্বভাবতই সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজ ও মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা কিন্তু সমাজকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে, সমানতালে মানুষের প্রতি অসচেতনতা সমাজে অস্থিরতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

আরও পড়ুন- টেলিকাইনেসিস

একটা দিক লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলোতে আমরা কিন্তু কখনওই ধর্ম নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুনি না, কারণ উন্নত দেশগুলোতে মানুষ নিজের কর্মে বিশ্বাসী, আর কর্মের মধ্যে থেকে ধর্মীয় মেরুকরণের গল্প করা সম্ভব নয়। স্বামীজির কথায় ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে আছে জনকল্যাণ, আর জনকল্যাণ মানুষকে সংযত করে। কোনও রাষ্ট্র বা দেশ যত জনকল্যাণমুখী প্রকল্প করে, সেখানে ধর্মীয় জিগির নয় জনকল্যাণমুখী প্রকল্প আলোচিত হয়। স্বামীজির কথায়, নতুন ভারতকে বুঝতে হলে বেরোতে হবে লাঙ্গল ধরে, গরিব চাষির হাতে হাত মিলিয়ে। সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনকে এক সুতোয় বাঁধলেই বোঝা যাবে নতুন ভবিষ্যৎ। ভারতবর্ষের মতো বহুত্ববাদের দেশে শতাব্দীর জমাটি অন্ধকার দূর করতে পারে আত্মবিশ্বাসের বোধ এবং ভবিষ্যতের প্রতি বিশ্বাস। এখন বিশ্বের অনেক দেশে ধর্মই প্রাণভোমরা, আর নিদারুণ দারিদ্র্য সত্ত্বেও সর্বত্র ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ নিদারুণ পরিলক্ষিত। এই ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারে পাশ্চাত্য সভ্যতার আধুনিক ব্যবস্থা অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে উন্নত কৃষিপদ্ধতি শেখানো, শিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া— এছাড়া বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো। কথায় আছে ভারতবর্ষকে জানতে হলে স্বামী বিবেকানন্দকে জানা খুব দরকার।

১৮৯৭-এ বিদেশ ভ্রমণের পর স্বামীজি ভারতবর্ষের যেখানে যেখানে বক্তৃতা করেছিলেন তাতে ছিল নতুন ভারতের কথা, যাতে জাতীয়তাবাদের তীব্র গতি ছিল এবং ধর্মের কফিনে পেরেক পোঁতার সূত্রপাত ছিল। নিজ ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা ও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব মানুষকে সুদৃঢ় করে তোলে। এটাই বাস্তব ধর্ম। স্বামীজির লেখায় ও ভাষণে ইসলাম, কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক ও নানান ধর্মের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে নানা আঙ্গিকে। কারণ ভারতবর্ষের শিকড়ের ভিত্তি তিনি বুঝেছিলেন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। ভারতের মাটিতে যে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বীজ পোঁতা হয়েছিল, সেই বীজ আজ মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সর্বধর্মের বীজ এতটাই গভীরে পোঁতা যা কোনও দল বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মানুষজনের দ্বারা টলানো যাবে না। বর্তমান সভ্যতায় ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণের মাধ্যমে সমাজকে উন্নত করে তোলার যে প্রয়াস পশ্চিমবঙ্গ সরকার করছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। মিনি ভারতবর্ষের রূপ নেওয়া পশ্চিমবঙ্গ আজ সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র। বহুবিধ ভাষাভাষীর মানুষের বাস এখানে। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি— বহু ধর্মের মানুষের সুরক্ষিত চাদর হল বাংলার মাটি। আর এই মুহূর্তে এক ভারত ও শ্রেষ্ঠ ভারতের একমাত্র নিদর্শন হল পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সরকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য নানান জনকল্যাণমুখী প্রকল্প করেছে এবং ১০ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে প্রায় ৮ কোটি মানুষকে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য জনকল্যাণমুখী প্রকল্প চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার (West Bengal Government)।
পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal) যে কোনও উৎসব কিন্তু সব ধর্মের মানুষ মিলিতভাবে পালন করে, যার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই দুর্গাপুজোতে বা ইদের মিলনে। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান— সব ধর্মের মিলিত মহান এই ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ যে নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে তা এক কথায় অনবদ্য, অসাধারণ। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্যে— সবক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এখন এগিয়ে। পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ে আধুনিকরণের যে রূপ স্বামীজি দেখতে চেয়েছিলেন তার সার্থক রূপ পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal)। স্বামীজির যে রিয়েল ইন্ডিয়ার খোঁজ— তা বোধ হয় বাংলায় এসেই সম্পূর্ণ হয়৷

Latest article