‘আমার ভাষা ষড়যন্ত্রে মরে না।’, লিখেছিলেন তরুণ কবি শাম্ব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভাষার কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা বাংলা ভাষা। বাংলার এক প্রখ্যাত কবির শব্দ ধার করে বলতে হয়, ‘এ বড়ো সুখের সময় নয়।’ কুচক্রী বিজেপির দৌলতে স্বাধীনতার পর এই প্রথম এতটা নজিরবিহীনভাবে বাংলা ভাষা তথা বাংলার মানুষ এবং সংস্কৃতির ওপর পরিকল্পিত এবং ভয়াবহ অবজ্ঞা এবং আক্রমণের এই দুর্দিন নেমে এসেছে। এর কারণ বোঝা অবশ্য কঠিন নয়। সারা দেশে হিন্দুত্ববাদের ধুয়ো দিয়ে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করে, ‘বিকাশ’-এর নামে ‘জয় শ্রী রাম’-এর নাড়া বেঁধে মিথ্যার ফানুস ওড়ানো সম্ভব হলেও বাংলার প্রহরী, জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে বিজেপির কোনও মিথ্যাচার, কোনও ষড়যন্ত্রই টিকতে পারেনি। আর এই কারণেই বিফল মনোরথ বিজেপি তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের আয়ুধ নিঃশেষ করে ফেলার পর বাংলাকে তছনছ করার শেষ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলা ভাষা ও বাংলার (West Bengal) অস্মিতার ওপর আক্রমণ। আর তাই রাজ্যে-রাজ্যে বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ দাগিয়ে দেওয়া, অকথ্য অত্যাচার, ডিটেনশন ক্যাম্প। কিন্তু, অত্যাচারও যে এত নিস্ফল প্রহসন হয়ে উঠতে পারে, তা অমিত মালব্যদের না দেখলে জানা যেত না।
স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরে বিজেপির থেকে জানতে হবে, বাংলা না কি আদৌ কোনও ভাষা নয়! তাহলে রবি ঠাকুর কোন ভাষায় লিখলেন সারাজীবন? এশিয়ার প্রথম নোবেল কোন ভাষায় এসেছিল? আরএসএসের ‘প্রিয়’ স্বামী বিবেকানন্দও কি তাহলে বাঙালি ছিলেন না? কাজী নজরুল ইসলাম কোন ভাষায় লিখে ব্রিটিশদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন? শরৎচন্দ্র, যাঁর লেখা পড়ে মুনশি প্রেমচাঁদ বলেছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ কথক’, তিনিই বা কোন ভাষায় লিখতেন? বাংলা বলে ভারতবর্ষে যদি কোনো ভাষাই না থাকে তাহলে ইউনেস্কোও কি ভুল বলল? এত কোটি মানুষের একটা ভূখণ্ড— তা কি এই একটা অর্বাচীন অস্বীকারের উচ্চারণেই মুছে যাবে?
রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই লিখে গেছেন : ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান—/তুমি কি এমন শক্তিমান!/আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান—/তোমাদের এমনি অভিমান।’ কিন্তু যারা আজ বাংলার ভাষা, মানুষ, তার কৃষ্টির ওপর ক্রমাগত এই সন্ত্রাস সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে, তারা বোধ হয় ভুলে গেছে, এই বাংলা ‘রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বীর সুভাষের মহান দেশ’। দাঙ্গাবাজ বিজেপি বোধ হয় জানে না, এই বাংলা ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ কানাইলালের বাংলা। এই বাংলার শহিদ সন্তানদের রক্ত দিয়ে কেনা এই গোটা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, আর সংসদে দাঁড়িয়ে যে সংবিধানের অবমাননা বিজেপি প্রতিদিন করে, তার নকশাও একজন বঙ্গসন্তানেরই করা। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলা (West Bengal) কোনওদিনই জাতপাত-ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে বিভাজন করেনি, আজও করে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরামরা আজ সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও, তাঁদের কণ্ঠ আজও স্তব্ধ হয়নি। তাঁদের স্বর গোটা দেশের কাছে, বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পেরেছেন মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভ্যাটিকান থেকে মাদ্রিদ, আসমুদ্রহিমাচল তাই তো জানে, এ-বাংলা ‘বিশ্ব বাংলা’।
বিজেপি কি জানে বাংলার (West Bengal) অস্মিতা কী? বাঙালি মনে করলে ঠিক কী করতে পারে, আর কী পারে না, তার কোনও ধারণাও নেই তাদের। সংবিধানকে দুমড়ে-মুচড়ে শুধুমাত্র ভোটবাক্সের রাজনীতি করা বিজেপির ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নতুন নয়। কিন্তু বারংবার ভোটের আগে বাংলায় ছুটে এসে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিজেপির শেষ কামড় ভাষা সন্ত্রাসের এই অর্বাচীন চেষ্টা। কিন্তু শুধু অর্বাচীন ভাবলে কম হবে। বাংলাকে নিয়ে আদ্যোপান্ত মিথ্যে কতগুলো ন্যারেটিভ ছড়ানোর জন্য সিনেমা থেকে সংবাদমাধ্যম, কোথাওই কোনও ফাঁক রাখেনি। বেঙ্গল ফাইলস তাদের সেই অসহনীয় মিথ্যাচারের তালিকায় নবতম সংযোজন।
আসলে বিজেপি বহুদিন ধরেই বাংলাকে দখল করার চেষ্টা করছে। বাংলাকে কবজা করতে পারলেই গোটা দেশটাকে পুরোপুরি রসাতলে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। আর তাই তাদের নিত্যনতুন ফন্দি। আর ঠিক এই কারণেই বিজেপি কোনও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু বাংলা আগেও হার মানেনি, এখনও মানবে না। যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাকে কখনও দমানো যাবে না। বাংলা তাই আজ বলছে : ‘হা হা হা পায় যে হাসি,/ভগবান পরবে ফাঁসি,/সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে।’ বাংলা বাঁচার জন্য মরতে জানে, জানে মারতেও, সে জানে ‘মৃত্যুকে ডাকতে জীবনপানে।’ ইতিহাস জানে, মিথ্যে দিয়ে, অর্থহীন অসত্য দিয়ে বাংলাকে কখনও জেতা যায় না। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে জননেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচগ্র মেদিনী’। তিনি বলেছেন, ‘গলা কেটে ফেললেও বাংলা ভাষায় কথা বলে যাব।’ এটাই বাংলা। প্রাণপণে লড়াইয়ের মাটি এই বাংলা। আর বাংলা সেই ভাষা যার জন্য প্রাণ দিয়েছিল একদল মানুষ। সেই ভাষা আজ আরও একবার সংকটের মুখোমুখি। বুক চিতিয়ে আমাদের লড়ে প্রতিহত করতে হবে বাংলার শত্রুকে, বাংলা ভাষার শত্রুকে। ভয় কী? আমাদের লড়াইয়ে সমস্ত ক্ষত বুক পেতে নিচ্ছেন আমাদের কান্ডারি, আমাদের নেত্রী স্বয়ংসিদ্ধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার ওপর সমস্ত আঘাত মুছিয়ে দেওয়া তাঁর স্নেহের আঁচলে নিশ্চয়ই আবার উদিত হবে : ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ।’ (‘পূর্ণ অভিনন্দন’, ভাঙার গান)। ততদিন ‘সুপ্ত বঙ্গে জাগুক আবার লুপ্ত স্বাধীন সপ্তগ্রাম!’