পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থান আমরা জানি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের গন্তব্যে পরিণত হবে সেটা বোধ হয় এক দশক আগেও কল্পনাতীত ছিল। বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। যন্ত্রাংশ নির্মাণ, রসায়ন, পাটশিল্প, চর্মশিল্প, বস্ত্রশিল্পের বিকাশে পশ্চিমবঙ্গ সবসময়ই এগিয়ে। অঞ্চলভিত্তিক শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এখন ‘ব্র্যান্ড’। হস্তশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পোলট্রি, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজ্য অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। অর্থনীতির শক্তিশালী মাপকাঠি বোঝাতে জিডিপি (Gross Domestic Product)কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সমস্ত শক্তিশালী জিডিপি উন্নত রাজ্যগুলি দেশের অর্থনীতিকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে শুধু নয়, আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করে।
জিএসডিপি-র (Gross state Domestic Product) হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ২০১০-১১ অর্থবর্ষে ৪৬০৯৫৯ কোটি টাকা থেকে প্রায় চারগুণ বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ১৭০০৯৩৯ কোটি টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার এবং অর্থনীতির সূচক অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিকে পিছনে ফেলে স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে। এই অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ উৎপাদন ক্ষেত্রে জিএসভিএ (Gross state value added) আনুমানিক ৭.২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। CMIE এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার অনান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম। কেন্দ্রীয় সরকারের Periodic Labour Force Survey (PLFS) ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪) রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ৫.৫ শতাংশ যা জাতীয় বেকারত্বের (৬.৪ শতাংশ) থেকেও কম। বাংলার এই শ্রীবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারী শিল্পের অগ্রগতি। কোভিড ১৯-এর অতিমারির পর অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কএর ঋণদানের পরিমাণ ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-সোমবার বৈঠক, চলছে একই ধাঁচে বাংলাদেশি বালখিল্যতা
পশ্চিমবঙ্গ গত ১২ বছরে ছোট ও মাঝারি শিল্পে ইতিহাস গড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ৮৮.৬৭ লক্ষ এমএসএমই রয়েছে যা দেশের মধ্যে দ্বিতীয়, এবং ভারতবর্ষের মোট এমএসএমই ১৪ শতাংশ। মহিলা পরিচালিত এমএসএমই-র সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ২৯০১৩২৪টি যা ভারতবর্ষে শীর্ষে এবং ভারতবর্ষের মোট মহিলা পরিচালিত এমএসএমই সংখ্যার নিরিখে ২৩.৪ শতাংশ। গত ১২ বছরে এমএসএমই সেক্টরে ৬.১৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। শিল্প গঠনের সংখ্যা ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থানের সংখ্যাটা প্রায় ১.৩৬ কোটি। বাংলার তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জোয়ার এসেছে, এই ক্ষেত্রে প্রায় ২.৬ লক্ষ ব্যক্তির চাকরি হয়েছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১.৪৫ লক্ষ ব্যবসারত সংস্থা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে এই অভাবনীয় বৃদ্ধির হার অব্যাহত রাখতে রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গ ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম (WBBCCS) চালু করেছে, যার মাধ্যমে ২ লক্ষ স্বনিযুক্ত যুব উদ্যোগীদের বছরে ২ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘শিল্পের সমাধান’ কর্মসূচি চালু করেছে, যার উদ্দেশ্য হল প্রতিটি গ্রাম এবং ব্লক স্তরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগীদের উৎসাহ দেওয়া। সাম্প্রতিককালে রফতানির সম্ভাবনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার West Bengal Export Promotion Policy 2023 কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যার উদ্দেশ্য আগামী কয়েক বছরে দেশের রফতানি ক্ষেত্রকে উন্নত করে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের আন্তর্জাতিক ট্রেডিং হাবে পরিণত করা। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা ব্যাপক, যার ফলে লজিস্টিক ব্যবসায় জোয়ার আসতে চলেছে। তার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লজিস্টিক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহায়তায় West Bengal Logistic Sector Development Policy 2023 ঘোষিত হয়েছে। বাংলা উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল কোনও কিছুরই অভাব নেই বাংলায়। গোটা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটকদের জন্য স্বর্গ। দেশ-বিদেশে থেকে ব্যাপকহারে লগ্নির প্রস্তাব হয়েছে পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে। এতে আগামী দিনে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের সু্যোগ তৈরি হবে।
পশ্চিমবঙ্গ টেক্সটাইল ইনসেন্টিভ স্কিম সংশোধনের ফলে বর্তমান টেক্সটাইল ক্ষেত্রের পরিধি ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যালকাটা লেদার কমপ্লেক্স (CLC) বিস্তারের জন্য গৃহীত প্রকল্প পরিবেশের ছাড়পত্র (EC) পেয়েছে। এফ্লুয়েন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম (ETC) এর উন্নতি ও সংস্কার শুরু হয়েছে। এছাড়া অভূতপূর্ব কাজ হয়েছে সিকিয়ড ল্যান্ড ফিল (SLF) সাইট, ক্ষুদ্র চর্মকারদের পুনর্বাসন, ফুটওয়্যার পার্কের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি। Scheme of Approved Industrial Park (SAIP)-এ ২০২০ প্রকল্পের অধীনে ৪৪টি ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গঠনের প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি চূড়ান্ত ও ২৩টি প্রসেসে আছে। SIDBI ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড-এর অধীনে ১৬৪.৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি পরিকাঠামো প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। WBIDC এবং WBIIDC বিভিন্ন শিল্প পার্কে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটকে জমি বরাদ্দ করেছে। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে চলেছে রাজ্য সরকার। সিলিকন ভ্যালিতে ২,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে আসছে জাপানের বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি সংস্থা ‘এনটিটি’।
আরও পড়ুন-কৃষক-পুলিশ হাতাহাতি! শম্ভু সীমান্তের রণক্ষেত্র
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) যুগে এই ধরনের বিনিয়োগ বিবর্তন আনবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানারকম জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সঙ্গে কৃষকদের এবং ব্যবসায়ীদের জন্য যে চিন্তাভাবনা করেছেন তা সাধারণ মানুষের জন্য আশার আলো সঞ্চার করেছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের উন্নয়নে জোর দেওয়ার জন্য ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ভরতুকি বা আর্থিক সহায়তা করছে রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গ বিগত এক দশকে প্রথম শ্রেণির অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এটাও সত্য যে, কোনও রাজ্যের পাওনা আটকে তাকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করার অর্থ সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে প্রতিহত করা। নানান প্রতিকূলতাকে জয় করে শিল্প, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি দিক থেকে প্রভূত উন্নতি হয়েছে বিগত এক দশকে, তার পুরো কৃতিত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উন্নত পরিকল্পনার। আগামী বছরে গোড়াতেই বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে, এবং তার প্রস্তুতি বৈঠকও ইতিমধ্যে হয়েছে। বন্ধের সংস্কৃতির বিলোপ, সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকের সহজলভ্যতা, সরকারের নিজস্ব ল্যান্ড ব্যাঙ্কের সুবাদে পশ্চিমবঙ্গ যে এখন ব্যবসার গন্তব্যে পরিণত হয়েছে তা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন দেশ-বিদেশের তাবড়-তাবড় শিল্পপতি।