বিজেপি-শাসিত হরিয়ানা রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে গেছিলেন পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তীর ২৪ বছর বয়সের তরুণ সাবির মালিক। গোমাংস ভক্ষণ করার সন্দেহে সেই হরিয়ানা রাজ্যের বিজেপির মদতপুষ্ট গোরক্ষক বাহিনীর হাতে খুন হতে হয় তাঁকে। সাবির মালিকের পরিবার ও তাঁর স্ত্রীর ক্রন্দনরত মুখ আজ সমস্ত সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই বেদনাময় আর্তি জাগরূক সমস্ত জনমানসকে আচ্ছন্ন করলেও হরিয়ানার বিজেপি সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের উপযুক্ত পদক্ষেপ ঘটনার পরবর্তী মুহূর্তে আমরা দেখতে পাইনি। আসলে সারা ভারতবর্ষ জুড়েই সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিজেপি যে ঘৃণার বাষ্প ছড়াচ্ছে তাতে আমরা সকলেই জর্জরিত। হরিয়ানার দাদড়ি জেলার সেই চারখি গ্রামে যে গুটি কয়েক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতেন তাঁরা আজ গ্রাম ছাড়া হয়ে গেছেন সেই ঘৃণার বাষ্পের আতঙ্কে। ঘটনার পরবর্তী সময়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম সেই গ্রামে পৌঁছে অনেক নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর প্রমাণ পেয়েছেন যে, গোমাংস সেটা ছিল না। বিজেপি এবং তাঁর অনুসারী এই ধরনের ‘গোরক্ষা বাহিনী’ সংখ্যালঘু মানুষের মনে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে চায়। তাত্ত্বিক বিচারে সংখ্যালঘু মানুষকে কেবলমাত্র সংখ্যার বিচারেই লঘু করার প্রয়াস চলে না, তাঁদের লঘু করা হয় ক্ষমতার পরিবৃত্ত থেকে, লঘু করা হয় মর্যাদার আসন থেকে। সংখ্যালঘু মানেই যেন দমনের এক বস্তু।
আরও পড়ুন-সম্পূর্ণ হয়েছে ৬০ শতাংশ কাজ, আগামী বছরের শেষেই নন্দীগ্রামে চালু হবে ৯০০ কোটির জলপ্রকল্প
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্মমতার দৃশ্য গত কয়েক মাস ধরে উঠে আসছে তাতেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাক। বঙ্গের বিজেপি রাজনৈতিক কৌশল খুঁজছেন এই সংখ্যালঘু দমনকে ঘিরে, বনগাঁ সীমান্তে ফানুস উড়িয়ে বঙ্গের প্রধান বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অথচ তাঁদেরই কেন্দ্রীয় মন্ত্রক আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উত্থাপনের প্রসঙ্গে স্থবির। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি আজীবন অন্তর্ভুক্তিকর রাজনীতিতে আস্থা রেখেছেন, সকল মানুষের সমানাধিকারের জন্যে যার কণ্ঠ গর্জে ওঠে তিনি সমাধানের ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছেন বিধানসভায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তি বাহিনী প্রেরণের পরামর্শ তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেছে। সংখ্যালঘু মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কোনও হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান নয়, সংখ্যালঘু মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাঁদের প্রতি সমতার এক বার্তা, তাঁদের মূল রাষ্ট্রীয় চালিকা শক্তির অংশীদার করতে চাওয়া। আজ যে বঙ্গীয় বিজেপি নেতৃত্বরা সংখ্যালঘুদের নামে ভোটের প্রকৌশল স্থির করছেন তাঁরা নিজেদের কেন্দ্রীয় অভিভাবকদের প্রশ্ন করুন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁরা নির্বাক কেন, সাথে এটাও প্রশ্ন করুন নিজেদের রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের তাঁরা সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে কেন লঘু করে রেখেছেন?
আরও পড়ুন-পুলিশ বাহিনীকে আগের ইউনিটে ফেরানোর নির্দেশিকা জারি এডিজি আইনশৃঙ্খলার
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে শতাব্দীপ্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়া হচ্ছে। আসামের বিজেপি সরকার রাজ্য মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদকে বাতিল করে দিয়েছে , শতাধিক মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানে। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই বিষয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, সেই রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গেলেও মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্তকেই বাতিল করেছে এবং কঠোর বাক্যে জানিয়ে দিয়েছে যে, রাজ্য কখনও কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অবমাননা করতে পারে না। সর্বোচ্চ আদালত আরও বলেছে যে, ‘‘ভারতবর্ষ বিভিন্ন সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ধর্মের সমন্বয় ভূমি” এবং এই সমন্বয়কে গুরুত্ব দেওয়া বাধ্যতামূলক। সর্বোচ্চ আদালতের আরও বক্তব্য যে, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার কেবলমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই ভারতের অন্যান্য ধর্মের মধ্যেও তার অস্তিত্ব আছে। এই ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার কোনওভাবেই ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী নয়।
আরও পড়ুন-‘দিদিকে বলে’ ঘর
ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস (এনসিপিসিআর) কিছুমাস আগে সমস্ত রাজ্যের মুখ্য সচিবদের কাছে চিঠি দিয়ে রাজ্যের সমস্ত মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ দেয়, রাজ্যস্তরের সমস্ত অনুদান বন্ধেরও সুপারিশও করা হয় এবং অমুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি না হওয়ার সুপারিশও সেখানে করা হয়। এই বিদ্বেষ মূলক ও খামখেয়ালি সুপারিশ ও সেই কমিশনের চেয়ারম্যানের বিষয়ে তলিয়ে দেখলে জানা যায় যে, চেয়ারম্যান মহোদয় প্রিয়ঙ্ক কানুনগো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উৎপাদিত ফসল, ২০১৫ সাল অবধি মধ্যপ্রদেশের ভারতীয় জনতা পার্টির যুব সংগঠনের দায়িত্বে তিনি ছিলেন, ২০১৫ সালের পরবর্তী সময়ে এই কমিশনের সদস্য পদে অভিষিক্ত হন এবং ২০১৮ সালে চেয়ারম্যানের পদে আসীন হন। সহজেই তাই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে বিজেপি নামক দল বিভিন্ন কমিশনকে ব্যবহার করে কীভাবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাঁদের নিজেদের ধর্মচর্চার, শিক্ষাচর্চার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দিচ্ছে। তবে নিপীড়িত মানুষের জয়যাত্রার পথ একমাত্র দেখিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কমিশনের চিঠির উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সদর্পে জবাব দেয় যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(২)-এ ভারতের সমস্ত নাগরিককে সেই অধিকার দেওয়া রয়েছে যেখানে তাঁরা তাঁদের পছন্দ মতো যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতির ভিত্তিতে কোনরকম বৈষম্য সেখানে চলবে না।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে হীনবল করে দেওয়ার নতুন এক সংযোজন হল ২০২৪ সালে বর্তমান লোকসভার প্রথম অধিবেশনে আনা ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল। অসত্যের প্রচারে বুঁদ করতে চায় বিজেপি সারা দেশের মানুষকে, বলা হচ্ছে রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড এই সম্পত্তির সঠিক দেখভাল করতে পারছে না এবং সরকারি বিভিন্ন সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ড বেদখল করে আছে। অথচ এর কোনও প্রামাণ্য পরিসংখ্যান নেই। ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মস্থান রক্ষা যেকোনও সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। প্রশ্ন সেখানেই যে, বিভিন্ন মন্দির পরিচালন কমিটিতে কেন্দ্র সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তাহলে ওয়াকফ পরিচালনায় তাদের হস্তক্ষেপ কি যথাযথ? বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া সেল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে নেট দুনিয়ায়, এই ধরনের ডিজিটাল বিভ্রান্তি ভারতের মাটিতে সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন করছে। বলা হচ্ছে ওয়াকফ বোর্ড যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে ঘোষণা করতে পারে, এটা সাংঘাতিক মিথ্যাচার কারণ সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি বৈধ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
আরও পড়ুন-আমডাঙায় গ্যাসের গোডাউনে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড
সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রাত্যহিক ঘৃণা ও ভয়ের পরিবেশ তৈরির নিত্যনতুন পন্থা উদ্ভাবন চলছে বিজেপির মগজে, সংখ্যালঘুদের হীনবল করেই তাঁদের পরিতোষ। তবে, আশার ও উদ্দীপনার আলো একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকেই নির্গত হয়, যিনি ২৪ বছরের তরুণ সাবির মালিকের স্ত্রীর চাকরির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন সঙ্গে তাঁর অসহায় সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্বভার নেন। বাংলা বোধ করি এখনও আছে সমন্বয়ে ও সুনিশ্চিতে!