কথা কও কথা কও অনাদি অতীত
দমদমের কাছেই ছিল রেকজানি গ্রাম। সেখানেই ছিলেন রামদুলাল আর তাঁর ঠাকুমা। বাপ-মা হারা একমাত্র নাতিকে মানুষ করার দায়িত্ব তাঁর। তাই রাঁধুনির কাজ নিলেন হাটখোলার দত্তবাড়িতে। অল্প বয়স থেকে রামদুলালও লেগে পড়লেন কাজে। সংসার সামলাতে হবে যে।
জাহাজ-ব্যবসায়ী মদনমোহন দত্তের কাছে তাঁর হাতেখড়ি। তারপর নিজের চেষ্টা আর দক্ষতাতেই শিপ-সরকারের পদে প্রোমোশন। রামদুলাল সেখানেই শিখেছিলেন ব্যবসার মুল মন্ত্র। আধুনিক সব ধরনধারণ। শিখেছিলেন আধুনিক বুক-কিপিং পদ্ধতিতে হিসেব রাখার কাজ। কাজে নিষ্ঠা তো তাঁর ছিলই। আর সবথেকে বেশি ছিল সততা। তারপর একদিন সেই সততার পুরস্কার হিসেবে তাঁর জুটে গেল এক লক্ষ টাকা। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল। এইবার সেই টাকা দিয়ে শুরু হল স্বাধীন জাহাজ ব্যবসা। রামদুলাল দে-র জাহাজ দৌড় দিল পশ্চিম গোলার্ধের আটিলান্টিক মহাসাগরের তীরে। সুদূর আমেরিকায়। তাঁর হাত ধরেই আমেরিকার সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যের যোগাযোগ। বোস্টন, সালেম, ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক দৌড়তে শুরু করল রামদুলালের জাহাজ।
আরও পড়ুন-নববর্ষে বর্ধমান মহাজনটুলি কথা
মতিলাল-এর মতিগতি
উত্তর কলকাতার কলুটোলার আর একজন বাঙালি আমদানি-রফতানির ব্যবসায়ী ছিলেন মতিলাল। মতিলাল শীল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারান। ফলে তাঁকে থাকতে হয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মতিলাল শীল কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভ করেননি কিন্তু তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা ছিল প্রখর।
মতিলাল ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে সামান্য বেতনে কিছুদিন চাকরি করেন। ফোর্ট উইলিয়ামে সেসময় চাকরির ফাঁকে সামরিক কর্মচারীদের তিনি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতেন। এইভাবেই তিনি শুরু করেছিলেন ব্যবসা। ধীরে ধীরে পুঁজির জোগাড় করেই স্বাধীনভাবে শিশি-বোতল এবং ছিপির ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন তিনি বালি খালের কাস্টমস দারোগার কাজও করেন। ১৮২০ থেকে ১৮৩৪ সাল— এই দীর্ঘ চোদ্দো বছর বিভিন্ন ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানে মুতসুদ্দির কাজ করেন। ওই সময়তেই মতিলাল আমদানি ও রফতানির ব্যবসায় পটু হয়ে ওঠেন। ফলে মতিলালের অর্থ আর ব্যবসার আরও প্রসার ঘটে। তিনি জাহাজ শিল্পে যোগ দেন। দেশের মধ্যে জাহাজ ব্যবসায়ে মতিলালই প্রথম বাষ্পীয় পোত ব্যবহার করেন। অনেকদিন আগেই কলেজপাড়ায় বইয়ের ব্যবসায় নেমেছিলেন বাঙালির আইকন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তৈরি করেছিলেন ছাপাখানা— সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপোজিটরি। পার্টনার ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
আরও পড়ুন-ব্রুকের মঞ্চে খাটল না রিঙ্কু ম্যাজিকও
কলঙ্কের চেয়েও কালো
বাঙালির ব্যবসায় এক ছিটেফোঁটা কালি লাগতে দেয়নি ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্য। ইংরেজদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার ব্রত নিয়ে সারা দেশে তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে স্বদেশি আন্দোলনের আগুন। ব্রিটিশদের তৈরি জিনিস বয়কট করার ডাক দিয়েছেন নেতারা। তখন চিঠিপত্র লেখা ও অন্যান্য দরকারি কাজ সারার জন্য ব্যবহার করা হত বিদেশি কালির ঝরনা কলম। এর থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলেন গান্ধীজি। সেই সময়ই রাজশাহির স্বাধীনতা সংগ্রামী অম্বিকাচরণ মৈত্র এবং সত্যবতী মৈত্রের দুই ছেলে ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্য মৈত্র বাবা-মায়ের আদর্শকে মাথায় নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে। গান্ধীজির স্বদেশি শিল্প গড়ার ডাকে সাড়া দিতেই স্বদেশি জিনিস তৈরির ব্যবসায় যুক্ত হন। ১৯৩৪ সালে রাজশাহিতে শুরু হয় ‘সুলেখা ওয়ার্কস’-এর। কুইঙ্কের মতো ব্রিটিশ কালির বিরুদ্ধে ‘সুলেখা কালি’ হয়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতীক। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর সহকারী তথা বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর চিফ কেমিস্ট তথা মুক্তিযোদ্ধা সতীশচন্দ্র সামন্তকে এ-ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেন। তিনিই ল্যাবে তৈরি তাঁর ‘কৃষ্ণধারা’ কলমের কালি তৈরির ফর্মুলা তুলে দেন ননীগোপালের হাতে। তৈরি হয় দেশীয় কালি— যা টেক্কা দেয় বিদেশি কালিকে। মৈত্র বাড়ির মেয়েরা কালি তৈরি করতেন আর পুরুষরা সেগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। বলতেন, ‘সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’
আরও পড়ুন-রাজ্যের ন্যায্য প্রাপ্য ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা ফেরত দিন, আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব: শাহকে বিঁধে অভিষেক
শরৎবাবুর ওষুধঘর : সাধনা ঔষধালয়
১৯১৪ সালের যোগেশ চন্দ্র-র সাধনা ঔষধালয় ছিল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ওষুধঘর। জ্বর হলেই ছুটে যেতেন। ওষুধ খেয়ে ফল পেয়ে যোগেশচন্দ্র ঘোষের ছেলে নরেশচন্দ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। ঢাকায় সাধনার কারখানায় এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চিকিৎসক নীলরতন সরকারের মতো বিখ্যাত মানুষেরা। কেবল ঢাকা নয়, পুরো ভারতবর্ষেই একসময় আয়ুর্বেদ ওষুধের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল সাধনা ঔষধালয়। কলকাতা ও এর কাছাকাছি এলাকায় একসময় পাঁচটি কারখানা ছিল সাধনার। প্রথমে কলকাতায় তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল দক্ষিণদাঁড়ির কারখানার মধ্য দিয়ে। তারপর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একে একে লেক টাউন, টালিগঞ্জ, কাশীপুর ও বেলুড়ে কারখানা হয়। একসময় ভারতের নানা শহরে ছিল সাধনা ঔষধালয়ের দোকান।
আরও পড়ুন-বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনায় কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
পথ দেখাল ঠাকুরবাড়ি
বাঙালির ব্যবসাকে পথ দেখায় ঠাকুরবাড়ি। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্রিটিশদের সঙ্গে তিনি একসঙ্গে ব্যবসায় নামেন। ব্যাঙ্ক, বিমা ও জাহাজের ব্যবসায়। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্যাঙ্ক ডিরেক্টর হওয়ার কৃতিত্বও তাঁর। ব্যবসার দূরদৃষ্টিতে তৈরি করেন— কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। প্রথম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ম্যানেজিং এজেন্সি। পাট, কয়লা, চা-শিল্প পরিচালনার দায়িত্বে। পরে জল পরিবহণের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। যুক্ত হয় কয়লা, গাঁজা ও চিনা চা আমদানি ও রফতানির সঙ্গে। শুধু উদ্যোগপতি নয়, ‘ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল’ তৈরি করে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম ব্যাঙ্কার।
মার্টিন কোম্পানি ও বেঙ্গল কেমিক্যাল
স্যার রাজেন মুখার্জি ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন বাংলার সর্বকালের সেরা উদ্যোগপতি। স্যার রাজেন মুখার্জি মিঃ মার্টিনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে মার্টিন কোম্পানি তৈরি করেন। ত্রিপুরা, পলতা, আমেদাবাদ ও বেনারসে জলসরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল এই কোম্পানি। এই শহরের বিভিন্ন হেরিটেজ সৌধ মার্টিন কোম্পানি তৈরি করেছে।
আরও পড়ুন-এবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে তলব সিবিআইয়ের
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের বেঙ্গল কেমিক্যাল বিভিন্ন ওষুধ ও পণ্য নিয়ে বাংলার বাজারে এসেছে। এদের ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন এখনও সারা দেশে গুরুত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। এই কোম্পানির ‘অ্যাকোয়াটাইকোটিস, ফিনাইল’ এখনও জনপ্রিয়। বাজারে তার সুনাম বজায় রেখেছে।
মেঘলা দিনের সঙ্গী
বাঙালির মেঘলা দিনের সঙ্গীকে ঘরে এনে দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বোস। তৈরি করেছেন বেঙ্গল ওয়াটার প্রুফ লিমিটেড। বাঙালির ডাকনাম— ডাকব্যাক। ওষুধ শিল্পে বাঙালি বিনিয়োগকারী ধীরেন দে-র দে’জ কেমিক্যালের অনেক আগেই বাংলার বাজারে এসেছে বেঙ্গল ইমিউনিটি। ১৯১৯ সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু, ডাঃ চারুচন্দ্র বসুদের এই উদ্যোগ সারা দেশের নজর কেড়েছে। পরিবেশবান্ধব সাইকেল শিল্পেও বিনিয়োগকারী ছিলেন সেই বাঙালি উদ্যোগপতি সুধীরকুমার সেন। তৈরি করেছিলেন সেন র্যালে কোম্পানি।
কে বলে বাঙালি ব্যবসাবিমুখ!
আরও পড়ুন-অধ্যক্ষের নিশানায় বিচারপতি!
দেশলাই শিল্পে বন্দেমাতরম— এই পণ্যের ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান ভোলার নয়। এই ম্যাচ বক্স শিল্প মূলত কুটিরশিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানেও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘বন্দেমাতরম’-এর প্রভাব দেখা যায়। আর বস্ত্রশিল্পে দাগ কাটে শ্রীরামপুরের বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলস, এ-ছাড়াও মোহিনী মিলস। জমিদার পরিবারের তিন ভাই— সুরেন, হেমেন এবং কিরণশঙ্কর রায় বেঙ্গল ল্যাম্প তৈরি করে বাঙালিকে শেখালেন গ্যাস বাতির ব্যবসা। আর ক্ষীরোদবিহারী চক্রবর্তী তাঁর ক্যালকাটা ফ্যানস-এর সাহায্যে ঠান্ডা রাখতেন বাঙালিকে। হোসিয়ারি শিল্পে ‘গোপাল হোসিয়ারি’ তার গুণমানের জন্য আজও জনপ্রিয়। ব্যাটারি শিল্পে ‘ভারত ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং’ একসময় অতি পরিচিত নাম ছিল। পর্যটনে শ্রীপতি চরণ কুণ্ডুর ‘কুণ্ডু স্পেশাল’ সুনাম বজায় রেখে এখনও বর্ধমান। বেকারি শিল্পে ‘আর্য বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারি’ একসময়ের পরিচিত নাম। কে বলে বাঙালি ব্যবসাবিমুখ!
আরও পড়ুন-বেলুড় মঠে রাজ্যপাল
সপ্তডিঙায় বাঙালির বাণিজ্যযাত্রার নতুন গল্প
বাঙালি তারকা উদ্যোগপতিদের খোঁজ অনেকেই রাখেন। আজও। বাঙালি এখন ব্যবসায়েও আর্ন্তজাতিক হচ্ছে। ব্যবসার সীমানা পাল্টাচ্ছে। ধরনও বদলাচ্ছে। বড় উদ্যোগপতিদের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি উদ্যোগপতিরা এখন নিজস্ব ব্যবসায় নেমেছেন।
বাংলার ব্যবসা তাই ভারতের মানচিত্রে ছয় নম্বর সারিতে উঠে এসেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কুটিরশিল্পে প্রায় ১৪ শতাংশ বিনিয়োগ হয় এই বাংলা থেকে। নাম না-জানা বাঙালি ব্যবসায়ীরা এখন পর্যটন শিল্পে স্বল্প বিনিয়োগ করছেন। বাংলার হস্তশিল্প, লোকশিল্প এখন সাগর পাড়ি দিচ্ছে। সম্পদশীল এই বাংলার ব্যবসার ছোট ছোট দীপ যদি জ্বলতে থাকে, তাহলে অর্থনীতির দুনিয়ায় আলোকিত হবে বাংলা এবং বাঙালিরা। পুঁজি দখলে এলেই প্রতিষ্ঠা হবে নিজের অধিকার নিজের ক্ষমতা। তৈরি হবে নতুন বাঙালি স্বদেশিয়ানা। বাঙালির রক্তে আছে ব্যবসা, ঐতিহ্যে আছে ব্যবসা। ব্যবসাদার বাঙালির বিশ্বায়নের আশায় পথ চেয়ে আছে সকলেই। একদিন চটকলগুলো আবার উঠে দাঁড়াবে, ডানলপ, বেঙ্গল কেমিক্যালস চলবে রমরমিয়ে। আবার তৈরি হবে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে বাঙালির বাণিজ্যযাত্রার গল্প। মধুকর ডিঙা, চাঁদ সওদাগর ও কমলে-কামিনীর গল্প গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে প্রাণময় হয়ে উঠবে।