বিবাহমঙ্গল

হিন্দু বিবাহেরই অঙ্গ বৈদিক বিবাহ। এই বিয়ে শুধু মন্ত্র আর আচারনির্ভর কোনও অনুষ্ঠান নয়, পারস্পরিক প্রেম, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং প্রার্থনার উপরেও রয়েছে এর ভিত্তি। বৈদিক যুগে আটপর্বের বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। এই বিবাহের রীতিনীতি, আয়োজন, ভিন্নতা নিয়ে লিখলেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

সুস্থ জীবন, সুস্থ সংস্কার আর রুচিশীল সমাজ ব্যবস্থা চালাতে বৈদিক আচারের বিয়েই মান্যতা পেয়েছে চিরকাল। হিন্দু বৈদিক বিবাহের (Bengali Marriage Ceremony) আচার আর অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে আমাদের সমাজজীবনে চর্চার শেষ নেই। বিবাহের আয়োজনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, ধৃতিহোম, চতুর্থী হোম। হিন্দু বিবাহের এই প্রাচীন লৌকিক আচারের সঙ্গে বৈদিক প্রথাগুলির তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। মাঙ্গলিক আচারের বিবাহের এই প্রাচীন রীতিনীতিগুলির সঙ্গে একটি সাযুজ্য রয়েছে। হিন্দু মতের এই বিয়েতে সাত পাকের সাত প্রতিজ্ঞা কী কী, তা মূলত পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ মহিলারাই এই রীতিনীতি মনে রেখেছেন চিরকাল। বৈদিক আচারের বিয়েতে জীবন যেন একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রেম, ভালবাসায় বন্দি হয়।
বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। যেখানে দুটি মানুষ একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, সংসার পরিচালনা করে, সমাজ এগোতে থাকে। সময় পেরিয়ে তাই আজও প্রাসঙ্গিক বৈদিক বিবাহ। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী বিবাহের সংজ্ঞা আলাদা, রীতিনীতি লোকাচার আলাদা তবুও এর সারমর্ম একই। বাঙালি হিন্দু বিয়ের লৌকিক আচার আজও বহুবিধ। সেখানে আঞ্চলিকতার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
বাংলার বিয়ের (Bengali Marriage Ceremony) লৌকিক প্রথা, বর্ণ, গোষ্ঠী, এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং সেইসব প্রথাকে ঘিরেই রচিত হয়ে এসছে বিবাহমঙ্গলের নানাবিধ অনুষ্ঠান। যেমন আজও হিন্দু বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছু লোকপ্রিয় আচার রয়েছে, যেমন একটি হল সাতপাকে বাঁধা। ছাঁদনাতলায় বরের সামনে কনেকে পিঁড়িতে বসিয়ে নিয়ে আসা হয়। কনের মুখ পানপাতা দিয়ে ঢাকা থাকে। পিঁড়িতে বসিয়ে বরের চারপাশে কনেকে ঘোরানো হয় সাতবার। একেই বলে সাতপাক। এরপর কনে মুখ থেকে পান পাতা সরিয়ে বরের দিকে তাকায়। আর একেই বলে শুভদৃষ্টি। এরপর হয় মালাবদল। শিবঠাকুরের আপন দেশে তারই প্রিয় আকন্দের মালা পরানো হয় কনেবউ আর বরের গলায়। অগ্নিদেবতাকে সাক্ষী রেখে আগুনের চারপাশে বর-বউকে ঘোরাতে ঘোরাতে সাতপাকে বাঁধা পড়ে যায়। সেই আগুনের চারপাশে ঘুরতে গিয়ে বর-বউ একে অপরকে অনেক প্রতিশ্রুতিও দেয়। আজ সেটা কেউ তেমন না জানলেও বৈদিক যুগে বিবাহের সময় স্বামী শুকনো ভাতে ঘি যোগ করে পাঁচটি বেদ মন্ত্র পাঠ করতেন। এই মন্ত্রগুলির মাধ্যমে স্ত্রী তাঁর স্বামীর দীর্ঘায়ু, শান্তি আর সম্প্রীতিতে ভরা বিবাহের জন্য প্রার্থনা করতেন। প্রাচীন কালের বৈদিক যুগে বিবাহের রীতিনীতির মধ্যে নিয়মের বেড়াজাল। স্বামী শুকনো ভাতে ঘি যোগ করে পাঁচটি বেদমন্ত্র পাঠ করতেন বিয়ের সময়।
সেক্ষেত্রে প্রতিটি পাঠের শেষে, শুকনো চাল অগ্নিকে অর্পণ হিসাবে পবিত্র আগুনে নিক্ষেপ করা হত। হিন্দুমতের বিয়েতে সাত পাকের সাত প্রতিজ্ঞা রয়েছে বেশ অন্য রকমের। অগ্নিদেবতাকে বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশে বর-বউকে ঘুরতে দেখা যায়। এ যেন লজ্জা নিবারণের আবহেই বিবাহের মাঙ্গলিক আয়োজন সারা। হস্তবন্ধনও চালু রয়েছে কোথাও কোথাও। সমাজজীবন আর জনগণকে সাক্ষী রেখে এমন বিবাহের আয়োজনে মুগ্ধ বাঙালি।
বৈদিক যুগের বিবাহের প্রকার ভেদগুলিও বেশ অন্য রকমের।
আজও হিন্দু ধর্মে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা অবৈধ। সেক্ষেত্রে হিন্দু বিবাহের প্রকারভেদগুলি মেলে বিবিধ। মনুসংহিতায় বিবাহের আটটি প্রকারের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল— ব্রাহ্ম বিবাহ, আর্য বিবাহ, প্রজাপত্য বিবাহ, অসুর বিবাহ, গান্ধর্ব বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ, দৈব বিবাহ, পৈশাচ বিবাহ।
হিন্দুধর্মে বিবাহের গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। তাত্ত্বিকদের অনেকের অভিমত হিন্দু বিবাহকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারমূলক অধ্যায় বলা হয়ে থাকে। এই হিন্দু বিবাহের ইতিহাসটিও বেশ পুরনো। প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ আর মহাভারতের মতো মহাকাব্যগুলিতে বহুবিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বিবাহের বিধানে (Bengali Marriage Ceremony) নেই সেই রীতি।
হিন্দু ধর্ম অনুসারে আট প্রকারের বিবাহ চালু রয়েছে। হিন্দু ধর্মে বিবাহকে সাত জন্মের বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিবাহকে ষোলোটি ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে পনেরোতম ধর্মানুষ্ঠান বলা হয়। যেখানে একজন ব্যক্তি তার ব্রহ্মচারী জীবন থেকে গৃহস্থের জীবনে প্রবেশ করেন এই বন্ধনের আচারের পরে। তেমনই বত্রিশ বন্ধনে ঘর। মনুস্মৃতিতে এই বিবাহকে তাঁদের ধরন অনুসারে আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেক ভাগের ভিত্তিতে বিবাহ করা এক একটি ঐতিহ্য।
হিন্দু ধর্মের আট বেড়াজালের বিবাহের ধরন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং তা আজও বেশ জনপ্রিয়।

ব্রহ্ম বিবাহ
এই ব্রহ্ম বিবাহকে হিন্দু ধর্মে সেরা বিবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বিবাহের বন্ধনে যেখানে দুটি পরিবারের মিলন ঘটে। সে মিলন আত্মিক। এই ব্রহ্ম বিবাহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল কন্যাদান। ব্রহ্ম বিবাহের পদ্ধতিতে বর এবং কনে উভয়েরই ব্রহ্মচর্য আশ্রম থেকে গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ আবশ্যক! অর্থাৎ তাদের বয়স পঁচিশ বছরের বেশি হতে হবে, এটাই রীতি। শুধু তাই নয়, এই ব্রহ্ম বিবাহের জন্য কনে ও বর উভয়কেই একই বর্ণের হওয়া আবশ্যক। এই বিবাহ রীতিতে প্রথমে বরের পরিবারের সদস্যরা একটি সম্পর্ক নিয়ে কনের বাড়িতে যান আর সেখানে গিয়ে বিবাহের প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে, কনের পরিবারের কাছ থেকে বিবাহের সম্মতি পেলে, সম্পর্কটি নিশ্চিত বলে বিবেচিত হয়। পরে এই বিবাহ সম্পূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান আর বৈদিক মন্ত্র সহকারে সম্পন্ন হয়। যেখানে কনের পিতার বিবাহ হয় এবং তিনিই কন্যাকে বরের হাতে সম্প্রদান করেন। কন্যাদানের পরে, সেই মহিলাকে বরের পক্ষের হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই রীতিতে পরে কনেকে বরের ঘরে অবস্থান করে তার জীবনের কর্তব্য পালন করতে হয়। এটাই এই বিবাহের রীতি।

ঐশ্বরিক বিবাহ
এই বিবাহের রীতিটিও আশ্চর্যজনক ভাবে একরকম ব্রাহ্ম বিবাহেরই একটি রূপের প্রকাশ যেন।
বিবাহের এই রীতিতে তেমন কোনও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থাকে না। এই রীতিতে বিবাহ হত যখন, যে-সময় কোনও ব্যক্তি তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে অক্ষম হলে শেষ পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে কিংবা বিবাহের উপযুক্ত মেয়েটির নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে বিয়ে দেওয়া না গেলে কিংবা তার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে না পেলে, সেই পরিস্থিতিতে, তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ে একজন নিখুঁত পুরুষ বা জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে দিতেন। বিবাহের সেই আয়োজনে তিনি তাঁর মেয়েকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে দান করতেন। এই বিবাহের রীতিটিকে ঐশ্বরিক বিবাহ নামকরণ দেওয়া হয়েছে। যদিও ধর্মীয় শাস্ত্রে যতদূর সম্ভব ঐশ্বরিক বিবাহ না করার কথা বলা হয়েছে। তবুও সে-কালের সমাজ জীবনের পরিস্থিতি অনুসারে এই বিবাহটিও করা উপযুক্ত বলে বিবেচিত হত।

অর্ষ বিবাহ
সাধারণত এই বিবাহে বরপক্ষের লোকেরা বিয়ের বিনিময়ে কনে পক্ষকে গরু, ষাঁড় দান করত। এই বিবাহতে কোনও ধরনের অর্থের বিনিময় হত না। তাই এই বিবাহটিকে গোদান বিবাহও বলা হত। এই বিয়েটি মূলত উপজাতি বা দরিদ্র পরিবারগুলিকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেও করা হত। এই বিবাহের মাধ্যমে বরপক্ষ ফি হিসেবে একটি গরু দান করত।

প্রজাপত্য বিবাহ
প্রজাপত্য বিবাহে কনের বাবা-মা বিয়ের জন্য বরপক্ষের তেমন সম্মতি নেন না। এবং অল্প বয়সেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতেন। এই বিবাহটি বর্তমানে একটি শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই বিবাহে তাঁর মেয়েকে বরের হাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে, মেয়ের বাবা তাঁর মেয়েকে ছেলেটির বাবার হাতে তুলে দেন। সেই কারণেই বিয়ের পর মেয়েটি তার শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়। যেহেতু তারা তখনও ছোট থাকে তাই কনেকে কন্যা হিসেবে ঘরে রাখা হয়। অপরদিকে গৃহস্থালি জীবন শুরু হলে তাদের একসঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। এটিও ব্রহ্ম বিবাহের একটি রূপ। শুধুমাত্র এই বিবাহে প্রথমেই বিবাহ দেওয়ার অনুষ্ঠান করা হয়।

আরও পড়ুন-বিয়ের পোশাকের স্বকীয়তায়

গান্ধর্ব বিবাহ
আজকের সময়ের মতে এই বিবাহটিকে প্রেম বিবাহও বলা যেতে পারে। তবে এটি এমন একটি বিবাহ ছিল যেখানে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা একে অপরকে পছন্দ করতেন কিন্তু তাঁদের পরিবার এই বিবাহতে রাজি ছিল না। এই কারণেই এমন বিবাহটি তার অনুমতি ছাড়াই করা হত। এই বিবাহটিকে গান্ধর্ব বিবাহের বিশেষ্য দেওয়া হয়েছে। এই বিবাহতে তারা কোনওরকম বড় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াই বিবাহ করতেন। ইতিহাসে দেখা যায় শকুন্তলার সঙ্গে মহারাজ দুষ্মন্তের বিবাহ গান্ধর্ব বিবাহের শ্রেণিতে পড়ে।

অসুর বিবাহ
এই বিবাহটিকে যথাযথ বিবাহের শ্রেণিতে রাখা হত না। সাধারণত দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে এই বিবাহটি বেশি ঘটত। যেখানে একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য মূল্য দিতে হত। এতে, কনের পক্ষের লোকদের বেশি টাকা দিয়ে, বরপক্ষ মেয়েটির সঙ্গে চুক্তি করত। আর এভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হত। তবে এই ধরনের বিয়ে তখনই ঘটত যখন পুরুষের কোনও ত্রুটি থাকত। নিম্নবর্ণের হত অথবা মেয়েটির জন্য উপযুক্ত ছিল না পাত্রটি। বরের চাইতে কনে বড় হওয়াতেও এমন বিয়ে হত। যদিও শাস্ত্রে এই বিবাহকে শুভ বলে মনে করা হয় না।

রাক্ষস বিবাহ
যখন একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা একে অপরকে পছন্দ করে তখন বরপক্ষের পরিবারের সদস্যরা এতে একমত হলে এবং কনের পক্ষ এতে একমত না হলে, সেসময় মেয়ের পছন্দ দেখে তাকে বিয়ে করাটা শাস্ত্রে রাক্ষস বিবাহের আওতায় পড়ে। ভগবান কৃষ্ণেরও একটি রাক্ষস বিবাহ হয়েছিল যেখানে রুক্মিণী তাঁকে পছন্দ করেছিলেন তবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে অপহরণ করে বিয়ে করেছিলেন। এছাড়াও, অন্যান্য বিখ্যাত বিবাহের উদাহরণ রয়েছে রাক্ষস বিবাহ নিয়ে। যেমন অর্জুনের সঙ্গে ভগবান কৃষ্ণের বোন সুভদ্রার বিবাহ এবং সায়ঙ্গিতার সঙ্গে মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিবাহও একটি রাক্ষস বিবাহ ছিল।

পৈশাচ বিবাহ
এই বিবাহকে শাস্ত্রে সবচেয়ে অন্যায্য শ্রেণিতে রাখা হয়। যখন কোনও মেয়ে হয় তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, অথবা গভীর ঘুমে থাকে, কিংবা অন্য কারও সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, সেই বিবাহকে পৈশাচ বিবাহ বলা হয় যা একটি অন্যায্য বিবাহ। একজন মেয়েকে তার সম্মতি ছাড়াই একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং যখন সে জ্ঞান ফিরে পায়, তখন সে জানতে পারে যে সে বিবাহিত! এমন বিবাহ শাস্ত্রে পৈশাচ বিবাহ।

Latest article