বৃথা গেল বিভাজনের নীতি জিতে গেল বঙ্গের সম্প্রীতি

রাম নবমীকে ঘিরে উদ্বেগ উত্তেজনা, দুইই ছিল। কিন্তু বাংলার মা মাটি মানুষ বিভেদের নষ্টামিকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য এক আবহ অন্বিত করল এই ধর্মীয় গোঁড়ামির সংকীর্ণতায়। বদলে দিল ছবিটা। কীভাবে? বিশ্লেষণ করছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

মোথাবাড়ির মিথ্যাচার ভেঙে চুরমার করে দিলেন মালদারই মুসলমান সমাজ। চড়া রোদে রামনবমীর মিছিলে ক্লান্ত,বিধ্বস্ত রামভক্তদের হাতে ঠাণ্ডা সরবতের গ্লাস তুলে দিলেন তাঁরা। সঙ্গে বোনাস হিসেবে বাংলার আবেগের অন্যতম রসদ মিষ্টি। মিথ্যে প্রোপাগান্ডার গ্যাস বেলুনে ফুলেফেঁপে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে মিছিলে সওয়ার হয়েছিলেন যে ভক্তবৃন্দ তাঁরা তো গলে জল। আরে মাটিটা যে বাংলার। যোগীর মনুবাদী কর্তৃত্বের হাথরস বা গোধরার গণহত্যার ভূমি নয়।
পরম আত্মীয়তার আপ্যায়নে বিগলিত হয়ে ভক্তরা তখন আলিঙ্গন আর কোলাকুলিতে ব্যস্ত। চোখের ঠুলিটা সরে গিয়েছে৷ মালদা তথা মোথাবাড়ির চেনা ছবি ফিরে এসেছে।
গত রামনবমীর দিন মালদার এই সম্প্রীতির ছবি চোখে পড়েছে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ সর্বত্র। ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকত মোল্লাকে দেখা গিয়েছে রামনবমীর মিছিলে। উত্তর কলকাতায় সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষের নেতৃত্বে মহম্মদ মজিদের ব্যবস্থাপনায় সম্প্রীতির স্বতঃস্ফূর্ত ছবি দেখা গিয়েছে। শ্রীরামপুরে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরভূমে শতাব্দী রায়, কাজল শেখ প্রমুখ যেভাবে বাংলা ও বাঙালির পরম্পরা সম্প্রীতির মাঠে চার-ছক্কা হাঁকালেন তাতে বিজেপির দাঙ্গা বাঁধানোর কুমতলব খান খান হয়ে গেল। ফুটবলের ভাষায় বললে, পিকে ব্যানার্জির ম্যান টু ম্যান মার্কিংয়ে বোতলবন্দী হয়ে সাম্প্রদায়িক গালিভারগুলো মূষিকের ন্যায় লিলিপুটে পরিণত হল।
প্রসঙ্গত, কদিন আগে এভাবেই ইদ-উল-ফিতর উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীরা যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, একসঙ্গে সিমুই ভাগ করে খেয়েছেন সেই ছবিটাই প্রতিফলিত হয়েছে রামনবমীতেও। দুর্গাপুজোতে যে জনপ্লাবন নামে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে তাতেও তো মিনি ভারতবর্ষের জয়গান। বড়দিন পালনেও একইভাবে একত্রিত হয় রাজ্যবাসী। মসজিদ,দরগা, চার্চ, গুরুদ্বারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক যেভাবে আমরা হাতজোড় করে পরমেশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
বাংলায় বছরভর এভাবেই রাম-রহিম একসঙ্গে বাঁচেন। স্বতঃস্ফূর্ত যাপনে সমৃদ্ধ হন। সাতসকালে চায়ের দোকানে ঠেক মারা থেকে জীবিকাযুদ্ধে হাতে হাত ধরে লড়াই চলে প্রতিনিয়ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়া,রোজকার অপরিহার্য ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, রান্নার গ্যাস, পেট্রল, ডিজেল-সহ জ্বালানীর আকাশচুম্বী দরের বিরুদ্ধে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বেঁচে থাকা। দিল্লির সরকারের চরম বৈরী মনোভাবের মধ্যেও কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বাঙালি বলে, ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’

আরও পড়ুন: খুলল বাংলার শিক্ষা পোর্টাল সঙ্গে বর্ধিত ডিএ

গৈরিক গোয়েবলসদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার মাধ্যমে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর তুমুল অপপ্রয়াস চলছে এবং আগামীতেও চলবে। দৃঢ় সংকল্পে হাতে হাত ধরে প্রশাসন ও রাজ্যের মানবিক সরকারকে পাশে নিয়ে এই প্রবঞ্চকদের পাশ কাটাতেই হবে। ওদের বিভেদকামী বিষমাখানো বাউন্সার ‘বাপি বাড়ি যা শট’-এর মতো গণতন্ত্রের মাঠ থেকে পগারপার করে দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে মোদির মরুভূমির মধ্যে মরূদ্যান হয়ে পাশে আছেন বাংলা তথা দেশের অবিসংবাদী নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সান্টাক্লজের মতো একের পর পরিষেবার ঝুলি নিয়ে। রাজ্য,দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃত কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথীর মতো একগুচ্ছ প্রকল্প মোদি সরকারের দু:শাসনের মধ্যে বাংলার মানুষের অক্সিজেন।
ভূ-ভারতে এমন সম্প্রীতির নিদর্শন কবে কোথায় দেখা গিয়েছে যা নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে রীতিমতো সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে। বস্তুত, মোদির ভারতবর্ষে যা অসম্ভব
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায় সেটাই ঘোর বাস্তব। রাজ্যে রাম-রহিমের এই সহযাপন যুগ যুগ ধরে প্রবহমান। সেই কবে রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালায় সুদূর আফগানিস্তানের রহমতের মিনির প্রতি পিতৃস্নেহে ধরা পড়েছে এই ছবি। বাঙালি যে উদারতা নিয়েই বাঁচে। প্রতিবছর শীতে কাশ্মীর থেকে আসা শাল ও বস্ত্র বিক্রেতারাও তো আমাদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছেন যুগ যুগ ধরে। চেনাপরিচিতদের বাড়িতে তাঁরা বউনি করেন কাজু কিশমিশ দিয়ে। তারপর বাঙালির বাড়িতে ভরপুর মাছভাত আর পায়েস খাওয়া। পাড়ার ছেলেপুলেদের সঙ্গে মিলে ক্রিকেট খেলতেও নেমে পড়েন শালওয়ালা দাদাভাইরা। কাশ্মীরের কতো গল্প শোনান। যাওয়ার সময়ে করজোড়ে বলে যান, ‘একবার তো ঘুমকে যাইয়ে।’ এই ভালবাসা, স্বতঃস্ফূর্ত সমাদর কেউ বাঙালির থেকে নিতে পারবে? শস্য শ্যামলা বঙ্গভূমি যে যুগ যুগ ধরে এই যাপনে ব্রতী।
রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-লালন ফকিরের ভূমি যে ভালবাসার কাঙাল। মালদা জেলার মোথাবাড়ি নিয়ে কারো কোনও মাথাব্যথা ছিল ক’দিন আগেও?
কালিয়াচক ভেঙে ডিলিমিটেশন হওয়া দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্যতম হল মোথাবাড়ি। বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি মেনে প্রকৃতির নিজের খেয়ালে গড়ে ওঠা অঞ্চল। বস্তুত, মোথাবাড়ি যেন উত্তরবঙ্গেরই বিজনবাড়ি, নকশালবাড়ির মতো এক মাথা উচু করে বাঁচা জনপদ। বছরের পর বছর ধরে নানা জাতি, নানা ধর্ম মিলেমিশে একাকার। সেই মোথাবাড়ি নিয়ে হঠাৎই শুরু হল মিথ্যাচার। সৌজন্যে ধর্মের সওদাগর ভারতীয় জনতা পার্টি। মোথাবাড়িতে নাকি হিন্দুরা নিরাপদ নয়। ওদের বস্তাপচা প্রচারের প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী হিন্দু খতরে মে হ্যায়। গৈরিক গোয়েবলসদের মিথ্যের বেসাতিতে হাজির তথাকথিত কিছু মোদি-মিডিয়া ও লাগামছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি করা ইউটিউবার।
বাজারে এমন হইচই শুরু হল যেন মোথাবাড়িতে হিন্দুরা নাকি বাড়িতেই থাকতে পারছে না। মহিলারা শাঁখা-সিঁদুর ছেড়ে হিজাবে মুখ ঢেকেছেন। হিজাব নয় নেটবাজির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যেটাকে সত্যি করে বাংলা মায়ের মুখ লজ্জায় ঢেকে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু রামনবমীর মোথাবাড়ি বুঝিয়ে দিল মালদা আছে তার নবাবি মেজাজ ও আভিজাত্যে। আমের আঁতুরঘরে আম বাঙালিয়ানায় বাঁচে বাঙালি। উত্তরপ্রদেশ বা গোবলয় থেকে কোনও অপসংস্কৃতি এখানে কোনওমতেই চাপানো যাবে না। পরজীবী, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া তাড়ানোর সবরকম কলাকৌশল জানে বাঙালি।
অতিথি হিসেবে এলে যেমন পেটপুরে মাছভাত খাওয়াতেও পারে, তেমনই অসভ্যতা করলে তার সমুচিত জবাব দিতেও জানে। ঠাকুরের কথা ধার করে বলা যায়, ‘বাঙালি কিন্তু ফোঁস করতেও জানে।’ কেউটে হোক আর গোখরো বাংলার মাটিতে অশান্তি পাকালে চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে দেওয়া হবে।\

Latest article