বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পথ দেখাচ্ছে দেশকে

লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আন্তরিক নির্ভরতার কাছে খড়কুটোর মতো উড়ে গেছিল জে পি নাড্ডা, আদিত্যনাথ যোগী, নরেন্দ্র মোদি, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের রথযাত্রার লোকদেখানো অতিশয্য। দিদির নেসেসিটির স্রোতে ভেসে যায় মোদির লাক্সারির খড়কুটো। লিখছেন চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

পরিযায়ী পাখি হয়ে ভোটভিক্ষা করতে আসা বসন্তের কোকিলদের বিতাড়িত করে উনুনের পাশে বসে আমজনতার রান্নাঘরের সুখ-দুঃখের গল্প শোনা আটপৌরে নারীতেই ভরসা অটুট বাংলার।
“What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”— বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখলের আজ থেকে একশো বছর আগের সেই অমর উক্তি সঠিক প্রমাণিত হল আবারও। সৌজন্যে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। কথায় আছে —“HISTORY REPEATS ITSELF”… বাংলার আজকের মাতঙ্গিনী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার মাটি যে উন্নয়নের এক দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, তা এক শতাব্দী আগের ব্রিটিশদের মতো করেই গত ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং রসায়ন ও সার মন্ত্রী জেপি নাড্ডা। পশ্চিমবঙ্গে বিগত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার বিজেপি শুরু করেছিল জগৎপ্রকাশ নাড্ডার নেতৃত্বাধীন রথযাত্রার মধ্যে দিয়ে। স্লোগান উঠেছিল — “আব কি বার, দোশো পার।” কিন্তু কোভিড-পরবর্তী বাংলার সাধারণ মানুষ যখন খুঁজছে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো একটা সামান্য খড়কুটো, সেখানে সাদা শাড়ি আর সাধারণ জীবনযাপনের রোজনামচায় অভ্যস্ত বাঙালির কাছে রথযাত্রার বাহুল্য ও অনাবশ্যক আড়ম্বর যে বড্ড বেমানান ও দম্ভের স্বঘোষিত মূর্ত প্রতীক! বিগত ৫০ বছর ধরে সাধারণ বাঙালির সমস্যাকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা মেয়েটি বুঝতে ভুল করেননি দৈনন্দিন রান্নাঘরের একান্ত প্রয়োজনীয়তাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বঞ্চনার শক্তিশেল বুকে নিয়েই অর্থনৈতিক কচকচানির দাঁড়িপাল্লাকে ছুঁড়ে ফেলে এই বাংলার প্রতিটি ঘরের নিজের মেয়ে হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভেঙে পড়া গ্রামীণ, নিম্নবিত্তীয় অর্থনীতির—
“মায়ের দেওয়া পাঁচশো টাকা
আঁচলে বেঁধে নে রে ভাই,
দীনদুখিনী মা যে মোদের;
তার বেশি আর সাধ্যি নাই।”
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আন্তরিক নির্ভরতার কাছে খড়কুটোর মতো উড়ে গেছিল জেপি নাড্ডা, আদিত্যনাথ যোগী, নরেন্দ্র মোদি, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের রথযাত্রার লোকদেখানো আতিশয্য। গ্রামবাংলার পাড়ায় পাড়ায় স্লোগান উঠেছিল— “হর হর দিদি, ঘর ঘর দিদি।” অর্থনীতির বাজারে তার প্রমাণ মিলে ছিল ঠিক ছ-মাসের মাথায় দুর্গাপুজোর মরশুমে। ঠান্ডাঘরে বসে জটিল তত্ত্বের বুলি আওড়ে যে অর্থনীতির চাকা আদতে ঘোরানো যায় না, তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাজারে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদার স্বাভাবিক চক্র বজায় রাখতে সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মহিলাদের হাতে ন্যূনতম অর্থের জোগান। কারণ, মায়েরাই এই সমাজের মেরুদণ্ড। তাঁদের অর্থের প্রায় সবটাই ব্যয় হয় শিশুর প্রয়োজন মেটাতে। অর্থাৎ বাচ্চার খাতা, কলম, খেলনা, পোশাকের মাধ্যমে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে প্রেরিত টাকা আবার ফিরে আসে বাজারেই। সমৃদ্ধ হয় অর্থনীতি। একটি সমাজের উন্নয়ন পুরোটাই দাঁড়িয়ে থাকে মায়েদের উপর। মায়ের হাতে অর্থ মানেই শিশুর কল্যাণ যা কিনা শক্তি জোগায় আগামীর সামাজিক পরিকাঠামোকে। পরিস্ফূরণ ঘটে সার্বিক সভ্যতার।

আরও পড়ুন: জমকালো উদ্বোধন, শীতের শহরে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ (ICSSR)-এর অর্থায়নে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পটি গ্রামীণ মহিলাদের আত্মবিশ্বাসকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে সাম্প্রতিককালে।” এর পাশাপাশি সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের মাসিক ব্যয় শেষ তিন বছরে ১০-১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জীবনযাত্রার মানের উন্নতিকে প্রতিফলিত করে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের আর্থিক সহায়তার জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং গৃহস্থালির খরচের মতো অপরিহার্য প্রয়োজনে ব্যক্তি-প্রতি মাসিক ব্যয় ১৭৬৪ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৪০ টাকা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই প্রভাবকে বাংলাদেশে মুহম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্রঋণের রূপান্তরমূলক প্রভাবের সঙ্গে তুলনা করেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন যে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ প্রবাহ বৃদ্ধি স্থানীয় বাজারকে উদ্দীপিত করে, উপকৃত হয় সমগ্র সম্প্রদায়।
তাই তো বিগত দিনগুলিতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সমালোচনায় সরব হয়ে মমতাময়ী মায়ের তরফে সাধারণ মানুষকে প্রদত্ত আস্থার অবলম্বনকে “ভিক্ষার দান”, “উৎকোচ” কিংবা “ঘুষ” বলে এ-যাবৎ কটাক্ষ করে আসা বিরোধীরাও আজ ব্যস্ত পূর্বকৃত কর্মের প্রায়শ্চিত্তে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত ঐতিহাসিক প্রকল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ঠিক দু-বছরের মাথায় ২০২৩ সালে মোহন যাদবের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মধ্যপ্রদেশের মেয়েদের জন্য চালু করে “লাডলি বেহনা”। ২০২৩-এর পর ২০২৪… মধ্যপ্রদেশের পর এবার মহারাষ্ট্র। আহা! দিদির অনুপ্রেরণার কী মহিমা! দেবেন্দ্র ফড়ণবিশের মুখ্যমন্ত্রিত্বে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারও ২০২৪ সালে নিজেদের রাজ্যের মহিলাদের উন্নয়নকল্পে বাংলার দিদির ব্রেনচাইল্ড “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার”-এর অনুকরণে শরণাপন্ন হয় “ লাড়কি বাহন” প্রকল্পের। নিজের থুথু নিজে গেলার এমন উদাহরণ ভারতের রাজনীতিতে রীতিমতো বিরল। মোহন যাদব, দেবেন্দ্র ফডণবিশেদের পর এবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই একই পদাঙ্ক অনুসরণের পথে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ভারতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ধরে নিয়ে সমগ্র বিজেপি যেন ব্যস্ত দেশজুড়ে তাঁরই মহিমা প্রচারে। সাম্প্রতিককালে আসন্ন দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন ঘিরেও একই চিত্র। বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি শনিবার দিল্লিতে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করে জানিয়েছেন, দল ক্ষমতায় এলে তাঁরা ‘মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা’ চালু করে প্রত্যেক মহিলাকে মাসে ২৫০০ টাকা সাম্মানিক দেবে। অর্থাৎ বছর চারেক আগে বাংলায় নাড্ডার রাজকীয় রথকে রুখে দিয়ে জনমানসে আস্থার অট্টালিকা নির্মাণকারী তৃণমূলের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ভর করেই দিল্লিতে ভোটরথ পার করতে মরিয়া বিজেপি। অবশ্য বিজেপির সর্বময় নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই যেখানে টুকলিবাজির পথপ্রদর্শক, সেখানে নাড্ডার আর দোষ কি”! তাই তো দিদির “কন্যাশ্রী”র কনসেপ্ট নাম বদলে মোদির কলমে ছড়িয়ে পড়ে “বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও” হয়ে। আসলে পরিযায়ী পাখি হয়ে ভোটভিক্ষা আর উনুনের পাশে বসে আমজনতার রান্নাঘরের সুখ-দুঃখের গল্প শোনা এক নয় কিছুতেই। তাই তো দিদির নেসেসিটির স্রোতে ভেসে যায় মোদির লাক্সারির খড়কুটো। বছর চারেক আগের পরাজয়ের স্মৃতি হাতড়ে জেপি নাড্ডা শেলির ভাষায় স্বগতোক্তি করেন — “If Fadnavis, Mohan, Modi come; can Nadda be far behind?”

Latest article