উচ্চ রক্তচাপ থেকে সাবধান হোন

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এখন লাইফস্টাইল ডিজিজ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন শুধু খাওয়া বা শোয়ার অনিয়ম নয়, দীর্ঘ মানসিক চাপও এর অন্যতম কারণ। রক্তচাপ বাড়লে যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ। মে হল জাতীয় উচ্চ রক্তচাপ শিক্ষা মাস। কীভাবে সচেতন থাকবেন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখবেন হাই ব্লাডপ্রেশার। জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যসমীক্ষার সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। পৃথিবীতে ১১৩ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের শিকার। ভারতে প্রায় ৫০% পুরুষ এবং ৩৬% মহিলা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। শুধু পঞ্চাশোর্ধ্ব নয়, এই তালিকায় রয়েছেন কমবয়সীরাও। ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে যাঁদের বয়স তাঁদের প্রতি পাঁচজনের একজন উচ্চ রক্তচাপের শিকার। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫%-ই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। বিজ্ঞানের ভাষায় উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাকে বলে ‘হাইপারটেনশন’ (Hypertension)।

সাধারণত একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে রক্তচাপের মান হয় ১২০/৮০ মিলিমিটার পারদ স্তম্ভের সমান। এই মান যখন ১৪০/৯০ থেকে বেশি বেড়ে যায় তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপ সংবহন তন্ত্রের সমস্যা ডেকে আনে। বাড়িয়ে দেয় স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো কঠিন রোগের ঝুঁকি। অথচ সমীক্ষা বলছে প্রতি পাঁচজনে একজন মাত্র মানুষ এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সচেতন এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমশ। এই রোগের গুরুত্ব বোঝেন না বেশিরভাগই।
ডায়াবেটিসের মতোই হাইপারটেনশন (Hypertension) হল নীরব ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলার। এর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয় সচেতনতা, নিয়মিত চেক আপ এবং জীবনযাত্রার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
মার্কিন এবং চিনের গবেষকরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশের যোগ রয়েছে। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী রক্তচাপ বাড়লে যে ধমনিগুলো রক্ত বহন করে সেই প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের সাপ্লাই কমতে থাকে এবং এর ফলে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর থেকে মস্তিষ্কে ছোট ছোট স্ট্রোকের সম্ভাবনা তৈরি হয়। হয়তো, অজান্তেই স্ট্রোক হতে থাকে। একে ব্রেন অ্যাট্রফিও বলে। এই অ্যাট্রফি ডিমেনশিয়াকে তরান্বিত করে। পরবর্তীকালে উচ্চ রক্তচাপের রোগী স্মৃতিভ্রংশের শিকার হয়।
বুঝবেন কী করে
উচ্চ রক্তচাপ বোঝার কিন্তু কোনও উপায় নেই। নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। যদি রক্তচাপ ১২০/৮০ mmHg-এর বেশি হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অনেক সময় সাময়িক চাপে বা টেনশনে হঠাৎ প্রেশার বাড়তে পারে তবে সেটা কমেও যায়।
১২০/৮০- mmHg এর প্রথম সংখ্যাটিকে বলা হয় সিস্টোলিক রক্তচাপ বা প্রেশার। এটা হল হৃদস্পন্দনের সময় ধমনির দেওয়ালে যে রক্তের চাপ থাকে সেটা।
১২০/৮০-র দ্বিতীয় সংখ্যাটি হল ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বা প্রেশার। এটা দুটো হৃদস্পন্দের ঠিক মাঝের ধমনির দেওয়ালে যে রক্তের চাপ সেটা।

রক্তচাপ কেন বাড়ে
এও এখন এক লাইফস্টাইল ডিজিজ। জীবনযাত্রার মান ঠিক করা জরুরি। খাবারে অতিরিক্ত পরিমাণে নুনের ব্যবহার। বেশি জাঙ্ক ফুড খাওয়া।
অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি।
অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ধূমপান এবং মদ্যপান।
পর্যাপ্ত শাকসবজি এবং ফলমূল না খাওয়া।
রাত্রে পর্যাপ্ত না ঘুমোনো।
অতিরিক্ত চা, কফি বা ক্যাফিন-যুক্ত পানীয় খাওয়া।
এটি খানিকটা জিনগতও। বংশে কারও থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা থাকে।
যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা। এর সঙ্গে বয়স যদি ষাটোর্ধ্ব হয় তবে সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন- ঐতিহাসিক ১৩ মে ফিরে আসুক বারবার

শারীরিক ঝুঁকি
উচ্চ রক্তচাপ দেহের সুস্থ অবস্থাকে ব্যাহত করে। এর ফলে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক-সহ দেহের অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পায়ের রক্ত চলাচল কমে যাওয়ায় পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ এবং ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

হৃদরোগ
অতিরিক্ত রক্তচাপ ধমনিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে ধমনির নমনীয়তা কমে যায়। এর ফলে হার্টে অক্সিজেন সমেত রক্ত সরবরাহ কমে যায় ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেলিওরের ঝুঁকি বাড়ে।

সেরিব্রাল স্ট্রোক
উচ্চ রক্তচাপের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত এবং রক্তে অক্সিজেন প্রবাহ দুই-ই কমে যেতে পারে। এতে মস্তিষ্কে ব্লকেজ এবং ধমনি বার্স্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এর ফলে ব্রেন স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
প্রতিরোধে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে প্রতিদিন ৫ গ্রামের চেয়ে বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। বিভিন্ন বাজার-চলতি চিপস, ফাস্ট ফুড, নোনতা খাবার, বিস্কুটে অতিরিক্ত পরিমাণে নুন মেশানো থাকে। তাই এই ধরনের খাবার খাওয়ার বিষয় সচেতন থাকা জরুরি।
নিয়মিত ব্যায়াম। যোগাসন, প্রাণায়াম জরুরি। ওজন অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
পটাশিয়াম মাত্রা বজায় রাখতে বিভিন্ন ফল ও সবজি খেতে হবে। কলা রাঙালু,বাদাম,আভোকাডো। এছাড়া টকদই, স্যামন, টুনা ফিশ খেতে পারলে ভাল।
ধূমপান এবং মদ্যপান ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকছে না
হাজার কিছু করলেও প্রায়শই রক্তচাপ ওঠানামা করছে। দুম করে প্রেশার বেড়ে যাওয়া যেমন খারাপ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে ঠিক তেমনই হঠাৎ নেমে যাওয়াও খারাপ এটাও হৃদযন্ত্রে প্রভাবে ফেলতে পারে। হঠাৎ রক্তচাপ কমলে মাথা ঘোরা, গা গোলানো, ঝিমঝিমানি এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে ওআরএস গুলে খেয়ে নিন। চুপচাপ বিশ্রাম নিন।
হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেলে বুকে একটা চাপ অনুভব হতে পারে। মাথা এক্ষেত্রেও ঘুরতে পারে। ঘাড়ে একটা যন্ত্রণা হতে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমে একটু চুপ করে বসে থাকুন বা শুয়ে পড়ুন। হালকা করে ঘাড়ে মাথা জল দিন। একটু স্নান করে ফেলতে পারেন। হাই প্রেশারের ওষুধ যাঁরা খান বাদ দেওয়ার প্রশ্ন নেই কারণ ওটাই আপনাকে সুস্থ রাখার একমাত্র পথ। কাজেই যদি মনে হয় ওষুধ খেতে ভুলে গেছেন যখন মনে পড়বে ঠিক তখনই খেয়ে নিন। বিশ্রামে থাকুন।

Latest article