রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রামের বেণীমাধব চৌধুরীর কন্যা। আসল নাম ভবতারিণী। ১২৯০ বঙ্গাব্দের ২৪ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তিনি সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন কবির সঙ্গে। বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চব্বিশ বছরের, মতান্তরে বাইশের যুবক। আর ভবতারিণী এগারো, মতান্তরে নয়-দশ বছরের। পিতৃগৃহের নাম পরিবর্তিত হয়ে যায় পতিগৃহে। ভবতারিণী হয়ে যান মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথই রেখেছিলেন এই নতুন নাম। বিয়ের আগে খুলনায় পড়াশোনার ততটা সুযোগ না থাকায় বিয়ের পরে স্ত্রীর ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করেন কবি। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোরতর সংসারী হয়ে ওঠেন মৃণালিনী।
আরও পড়ুন-বাধ্য হলেন বিপ্লবীরা
রৌদ্র ছিল। কোথাও যেন ছিল মেঘও। স্বামী জগৎ-বিখ্যাত মানুষ। তাঁকে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চেয়েও পাননি। অনেক কথাই ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কৌতূহল জাগে— কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ এবং মৃণালিনীর দাম্পত্য জীবন? এর উত্তর হতে পারে স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছত্রিশটি চিঠি। চিঠিগুলো মৃণালিনীর মৃত্যুর পর অন্তরাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। রেশমি-রুমালে ছিল সযত্নে বাঁধা। মৃণালিনীকে হারাবার একমাসের মধ্যেই স্ত্রীকে উদ্দেশ করে কবি লিখেছিলেন : ‘দেখিলাম খানকয় পুরাতন চিঠি—/ … গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।’
সন্তানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ছোট, তাই ঠাকুরবাড়ির ছোটবউ মৃণালিনী। মৃণালিনী তো কবির দেওয়া পছন্দের নাম; তাই ছোটবউ চিঠিতে হয়ে গিয়েছিলেন কবির একান্ত নিজের ‘ভাই ছুটি’। অবশ্য প্রথম পাঁচটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে সম্বোধন করেছেন ‘ভাই ছোটবউ’। যদিও শেষ পর্যন্ত ‘ছুটি’তেই থেকে গিয়েছিলেন। শুধু একটি বছরই চিঠিতে মৃণালিনী ছিলেন ‘ছোটবউ’। এই পত্রাবলী রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর দাম্পত্য জীবনের এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গ দলিল।
দু-বছরের বড় নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুর মতো। কিন্তু স্ত্রী মৃণালিনী কোনও দিনই কবির বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি। প্রবেশ করতে পারেননি কবির মানসসাম্রাজ্যের গভীরে। অন্যতম কারণ হয়তো বয়সের ব্যবধান। ভাবনাচিন্তার তারতম্য। তবে দুজনের সম্পর্ক যে যথেষ্ট মধুর ছিল, চিঠিগুলো তার প্রমাণ দেয়। মৃণালিনী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভরসার জায়গা। শান্তির জায়গা। পরম আশ্রয়। তাঁর পাঁচ সন্তানের মা। স্ত্রীর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। ছিল অধিকারবোধও। আর পাঁচজন স্বামীর মতোই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অভিমানী। ১৮৯০-এর জানুয়ারি মাসে সাহজাদপুর থেকে পাঠানো চিঠিতে তিনি মৃণালিনীকে লিখেছেন, ‘যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভালোমানষির কাল নয়। কাকুতি মিনতি করলেই অমনি নিজ মূর্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একেবারে জল।’
স্ত্রীর প্রতি ব্যাকুলতা, গভীর প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯০-এ জাহাজ থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে। কবি লিখেছেন, ‘রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড় খাটে একাধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম— বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না।’
আরও পড়ুন-রাজ্যের উদ্যোগে উত্তর দিনাজপুরে মোবাইল ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরি
দূরদেশে থাকলেও, রবীন্দ্রনাথ সমস্তকিছুই ভাগ করতেন স্ত্রীর সঙ্গে। জানাতেন নিজের শরীরের কথা। যেখানে যেতেন, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিতেন বর্ণনা। খোঁজখবর নিতেন পুত্র-কন্যাদের, তাদের দিতেন ভালবাসা, আদর, হামি। জলপথে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কবি, চিঠিতে বর্ণনা দিতেন তারও। রবীন্দ্রনাথ যে কতটা সংসারী ছিলেন, তারও সাক্ষ্য বহন করে কয়েকটি চিঠি। কোনও কোনও চিঠিতে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে কলকাতার প্রতি।
চিঠিগুলো রবীন্দ্রপ্রেমীদের জানা। বারবার ফিরে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, তাঁর সম্পাদিত সুচারু সযত্ন সংকলন ‘ভাই ছুটি’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। বই-শেষে যুক্ত হয়েছে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও বিশ্লেষণধর্মী সম্পাদকের তিনটি অনবদ্য রচনা। লেখাগুলো পড়ে জানা যায়, উনিশ বছরের দাম্পত্যজীবনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন মৃণালিনী দেবীও। দুঃখের বিষয় রবীন্দ্রনাথ তার একটিও সঞ্চিত রাখেননি বা রক্ষা করেননি। অথচ স্বামীর চিঠিগুলো যত্ন করে সঞ্চিত রেখেছিলেন কবিপত্নী! ঊনতিরিশ হননি মৃণালিনী দেবী, মারা যান। ছুটি নিয়েছিলেন ‘ছুটি’। আগে রবীন্দ্রনাথ কোনও কবিতায়, গানে মৃণালিনীর উল্লেখ করেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে তাঁর কলম থেকে নির্ঝরিত হয়েছিল শোকগাথা। কোনও কোনও কবিতায় আভাস মিলেছে অপরাধবোধের। চেয়েছেন ক্ষমাও। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘মৃত মৃণালিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন, তাতে রবীন্দ্রনাথকে স্বামী হিসেবে একশোয় একশো দিতে হয়।’ হয়তো ‘সাধারণ মেয়ে’ মৃণালিনীকে পুরোপুরি হারিয়েই নতুন করে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এইভাবেই মৃণালিনী থেকে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। যে-কারণেই, জীবনে বহু হাতছানি এলেও, একচল্লিশ-পেরোনো কবিকে দ্বিতীয় বিবাহের কথা ভাবতে হয়নি। প্রচ্ছদশিল্পী হিরণ মিত্র। পূর্বা প্রকাশন সংস্থা প্রকাশিত বইটির দাম ২৫০ টাকা।