কর্মজীবনে আমি গুজরাতের নয়, মধ্য কলকাতার একটি মহাবিদ্যালয়ে, সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করেছি। অজস্র ছাত্রছাত্রীকে হিসাবশাস্ত্র, কারবারি অর্থনীতি, বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার পাঠ দিয়েছি ডিগ্রি স্তরে। সেই সব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, বিভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়েরা ছিল। তাদের সবার নাম আমার মনে নেই।
কিন্তু আমি নিশ্চিত, বিলকিস বানো (Bilkis Bano) কোনওকালে আমার ছাত্রী ছিলেন না।
তবু, তবুও, যে অযুতসংখ্যক ভারতীয় বিলকিস বানো-কাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত, বিরক্ত ও আশঙ্কিত, বিলকিস বানোর সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তার সহমর্মী, আমি তাদেরই একজন।
ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমাদের মতো মানুষজনের যে গর্ববোধ ছিল, তা এই একটি ঘটনায় আহত, রক্তাক্ত। ঘটনাটি আর কিছুই নয়, বিলকিস বানো-সহ (Bilkis Bano) পাঁচজন মহিলা গণধর্ষিতা হয়েছিলেন, ১৪ জন খুন হন। তিন বছরের শিশু, একদিনের সদ্যোজাত, কেউ সেই নৃশংস তাণ্ডবকারীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই বীভৎস ঘটনায় যারা দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছিল, তাদের ছাড়ার ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাও এগারোজন ধর্ষক ও খুনি ছাড়া পেয়ে গেল।
টিভি-বিতর্কে শুনলাম, কেউ কেউ বিলকিস বানোর (Bilkis Bano) মানসিকভাবে ভেঙে পড়া নিয়ে কিছু বলতে চাইছেন। ধর্ষক আর খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলে ধর্ষিতা এবং নির্যাতিতাদের পরিবার কীরকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, সে নিয়ে সরব হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমিও মানসিকভাবে তাঁদেরই পক্ষে, এমনটাই অনুভব করছিলাম। তখনই পাল্টা যুক্তি শুনে শিউরে উঠলাম। শুধু বিলকিসের কান্নার কথা ভাবলে চলবে! ধর্ষক আর খুনিরা যে পনেরো বছর জেলে কাটাল, কষ্ট পেল, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। অস্যার্থ, মুসলমান বিলকিস বানো বলে তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল আর ধর্ষক ও খুনি হিসেবে সাব্যস্ত দোষীরা হিন্দু বলে তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করব না, এটা অন্যায়।
আমি বুঝলাম, আমি কেন বিলকিস বানোর কান্নায় আবেগে মেদুর হব? বিলকিস তো আমার ছাত্রী নয়।
আইনবিদরা নানা কথা বলছেন। বলছেন, ২০১৪-তে গুজরাত সরকারের নির্দেশিকা এবং ২০২২-এ ভারত সরকারের জারি করা নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছিল, ধর্ষক আর খুনিদের জেল থেকে ছাড়া যাবে না। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯২তে যে নির্দেশিকা দিয়েছিল সেটাকেও মৌন করে দেওয়া হল। এই নির্দেশিকাগুলো আইন কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়, পরামর্শমূলক। এগুলো মানার ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং, ধর্ষক ও খুনিদের কারামুক্তির সুপারিশ যাঁরা করেছেন তাঁদের কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল না, সত্যিই ছিল না। কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের দাবি কিংবা চাপটুকুও কি ছিল না?
কে জানে! আমি জানি না।
বিশেষত যখন বিলকিস বানো আমার ছাত্রী নয়।
বিলকিস বানো আমার ছাত্রী নয় বলেই তো আরও বেশ কিছু প্রশ্ন আমার ঠোঁটের ডগায় এসেও অনুচ্চারিত রয়ে গেল।
আচ্ছা, বিলকিস বানো মামলায় যেসব বিচারকরা বিচার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন, দোষী সাব্যস্ত করে ধর্ষক ও খুনিদের জেলে ঢোকানোর রায় দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোনওরকম আলাপ আলোচনা করে কি দোষীদের কারামুক্তির সুপারিশ কার্যকর করা হল?
আচ্ছা, সুপ্রিম কোর্ট তো বলেছিল, গুজরাতে বিলকিস বানোরা ন্যায়বিচার পাবে না আর সেজন্য ওই মামলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মহারাষ্ট্রের আদালতে। তাহলে কেন দোষীদের কারামুক্তির কথাটা ঠিক করার জন্য মহারাষ্ট্র আদালতের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার ইচ্ছা বিস্তর। কিন্তু শুধু দোষীদের দোষ বিচারের পরেও যে তাদের মুক্তিদানের ব্যবস্থা করা হল, সেটাই বিরক্তি, চিন্তা ও আশঙ্কার একমাত্র কারণ নয়। এগুলোর চেয়েও বড় আশঙ্কার কারণ অন্য ঘটনা।
ধর্ষক ও খুনি ছাড়া পাওয়ার পর তাদের ছাড়ার জন্য সুপারিশ করেছিল যে কমিটি তার একজন সদস্য বলেন, ওই দোষীরা ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ্য সংস্কার সুসংস্কার। তাই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে লালিত ওই ব্যক্তিবর্গ কোনও ভাবেই অন্যায় কর্ম করতে পারেন না।
আরও পড়ুন: সিপিআইয়ের দুই গোষ্ঠীর লড়াই প্রকাশ্যে
নির্ভয়া-কাণ্ডের পর দেখেছিলাম, সারা ভারত রাগে ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে। হাতে হাতে মোমবাতি জ্বলেছিল। মিছিলে মিছিলে ভরেছিল রাজপথ, নগরে নগরে। বিলকিস বানোর ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা দেখলাম না। সেই রাগ ও ঘৃণা, সেই বিরক্তি ও বিবমিষা, কোনও আজানা কারণে খানিকটা হলেও স্তিমিত।
এর কারণ দুটো হতে পারে— এক, কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা দু-দশক পর জনমানসে একই রকম ঝোড়ো প্রতিক্রিয়া তুলবে, এটা প্রত্যাশা করা যায় না। দুই, ওই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের যুক্তির সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজনে বিভাজিত দেশের একটা বড় অংশ মুখে না হলেও মনে মনে সহমত পোষণ করেন। আবার কেউ কেউ, আমার মতোই হয়তো ভাবছেন, বিলকিস তো আমার ছাত্রী নয়।
কারণ যাই-ই হোক না কেন, এই ঔদাসীন্য, এই প্রতিবাদী প্রকাশে ম্রিয়মানতা অনাকাঙ্ক্ষিত।
জার্মান দার্শনিক হানা আরেন্টের ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ বা ‘মন্দত্বের গতানুগতিকতা’ তত্ত্বের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই তত্ত্বে তিনি দেখান যে আমজনতা এতটাই বিবশ হয়ে পড়ে যে, তারা অপরপক্ষের বক্তব্য বুঝে উঠতে পারে না। অমানবিকতা তখন জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য, ক্ষমতা দখলের জন্য, কৌম পরিচয়ে আহ্লাদিত হওয়ার জন্য জনমানসে বৈধতা পেয়ে যায়। লোকে বুঝতেই পারে না, আসলে যেটা করা হচ্ছে সেটা অমানবিক।
আরেন্টের মনে হয়েছিল, এই ধ্যানধারণার অত্যুঙ্গ প্রকাশ দেখা গিয়েছিল নাৎসি যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ এইকমানের মধ্যে। তার মানে এই নয় যে এই জীবাণু অন্য কোথাও অন্য কারও ভেতর সংক্রমিত হয়নি। প্রতিটি সমাজেই পাপকে অন্যায়কে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। ভারতেও, বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে, সংখ্যাগরিষ্ঠর কৌমভাবনাকে তন্মাত্রজ্ঞান করে খারাপকে, অন্যায়কে, অনৈতিককে, মন্দকে তুচ্ছ কিংবা গতানুগতিক করে দেখানোর যে প্রবণতা বিলকিস বানো-কাণ্ডে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম সেটাই ভয়ের। সেটাই আগামীর ভারতের জন্য আশঙ্কার। সেটাই আমাকেও ভাবাচ্ছে।
যদিও বিলকিস আমার ছাত্রী নয়।