কলকাতায় তাঁর (Biresh Chandra Guha) নামে একটি রাজপথ আছে। তাঁর উদ্যোগেই ভারতে প্রথম প্রাণ রসায়ন বিদ্যা ও জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল বলে বলা হয়।
তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টাতেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছিল জৈব রসায়নের দু’বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স। এই বিজ্ঞানীই আবার ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গরিব মানুষের সেবায়। ঘাসপাতা থেকে প্রোটিন বিশ্লেষণের গবেষণা করে সন্ধান করেছিলেন মানুষের খাদ্যে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের।
‘ভিটামিন সি’ বিষয়ে গবেষণায় নিমগ্ন ছিলেন। বেশ কিছুকাল ধরে নিয়াসিন, ভিটামিন ও ভিটামিন সি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘অ্যাসকরবিক’ অ্যাসিড।
এই ভিটামিন সি’র অভাবেই হত স্কার্বি রোগ। ভিটামিন সি-র মলিকিউলার ফরমুলা হল C6H8O6. আজ এই মুহূর্তে করোনা সময়ে ভিটামিন সি যে কত প্রয়োজনীয় তাই আর নতুন করে বলতে হয় না।
যদিও দুই বিজ্ঞানী এডমন্ড হার্সট ও রসায়নবিদ ওয়াল্টার নরম্যান-এর হাতেই আবিষ্কৃত হয়ে নাম হয়েছিল ‘অ্যাসকরবিক অ্যাসিড’। ভারত তখনও বিজ্ঞানে ততটা উন্নত নয়, হলে হয়তো বাঙালি বিজ্ঞানীর কপালেও জয়তিলক পড়ত। এই বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম বীরেশ্বর গুহ। পার্কসার্কাস পেরিয়ে অদূরে আজও জ্বলজ্বল করছে বীরেশ গুহ রোড।
বীরেশচন্দ্রের মামা ছিলেন শিক্ষাব্রতী সমাজ সংস্কারক অশ্বিনীকুমার দত্ত। বাংলার বিপ্লবী জীবনের এক পরিচিত নাম। স্বাভাবিক ভাবেই বীরেশচন্দ্রের রক্তেও দেশপ্রেমের প্রেরণা। তাই তো এই বিজ্ঞানীকে স্নাতকস্তরে পড়ার সময় তখনকার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে নাম কেটে দেন তৎকালীন কর্তৃপক্ষ।
বিপ্লবী নিষিদ্ধ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার জন্য প্রেসিডেন্সি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভর্তি হলেন এই মেধাবী ছাত্র সেন্ট জেভিয়ার্সে। বিএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। এসএসসিতে রসায়নে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট।
এই সময়েই সান্নিধ্যে এলেন বাংলার আরেক গৌরবান্বিত বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতেই বৃত্তি পেয়ে চলে গেলেন ইংল্যান্ড। সেখানে মাস্টার হিসেবে পেলেন প্রথিতযথা গবেষক জ্যাক ডুমন্ড ও জৈব রসায়নের নোবেলজয়ী জন হপকিন্সকে। গবেষণা চললেও মন পড়ে দেশের মাটির জন্য।
- আরও পড়ুন: ১০ বছরের শ্রীতমার দেহদান বাবা-মার
ডিএসসি করে ফিরে এলেন দেশে। তাঁকে কাজে লাগাবার মতো চাকরি নেই ভারতে। তাঁর জন্য নতুন পদ তৈরি হল, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’ নামক প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সেখানে কাজ করা হয়নি। এই বিজ্ঞানীকে ডেকে নিলেন আরেক বিজ্ঞানী বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বললেন, ‘‘আমার এখানে আপনি ভিটামিনের ওপর গবেষণা করুন।”
সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করলেন জৈব রসায়নের স্নাতকোত্তর শিক্ষা। মন ভরল না। আবার ছুটলেন বিদেশ। সেখানে রসায়নের বৃহৎ কর্মকাণ্ড। লন্ডন সহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে দেখলেন, জানলেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন ভাবে পড়ানো হয়। আয়ত্ত করে ফিরলেন দেশে। সেই সঙ্গে গবেষণা করলেন মানব শরীরে যকৃতের মধ্যে ভিটামিন বি-২ এর অস্তিত্ব এবং ফলাফল।
দেশে ফিরে দেশের নানা বিভাগে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন নানা সময়ে। ভারত সরকারের খাদ্য বিভাগে উপদেষ্টা হয়ে যোগ দিয়েছিলেন। খাদ্যপুষ্টিগুণ বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাদ্যে প্রোটিন ভিটামিন বা খনিজ পদার্থ থাকাটা কত জরুরি। তাঁরই প্রয়াসে শুরু হয়েছিল ফুড টেকনোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এ দেশে খাদ্য সংরক্ষণ ও টেকনোলজির সবটুকুই তাঁর অবদান। আধুনিক ভারতের মর্ডান বায়োলজিস্ট হিসেবে পূজ্য। অন্যদিকে আবার দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনেরও সদস্য হয়েছিলেন
সব সময় চালিয়েছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। খুঁজেছেন মিষ্টি জলের মাছের সঙ্গে সামুদ্রিক মাছের খাদ্যের গুণাগুণ। এই গবেষণার মধ্যেও খুঁজেছেন কোন মাছে কতটা প্রোটিন বা খনিজ পদার্থ রয়েছে। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার নিয়োসিয়াজেন। জৈব রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
দেশে বিদেশে জৈব রসায়নের ওপর অজস্র বক্তৃতা প্রদান বা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এতসবের মধ্যেও দেশের প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা। পরম ছাত্রদরদি আজীবন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছিলেন ফুলরেণু গুহর মতো সমাজসেবী এবং মানবদরদি নেত্রীকে। তিনি বাংলার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে সমাজসেবার যা কিছু কাজে একসময় ফুলরেণু গুহর নাম সর্বজনবিদিত। বীরেশ গুহর মতো তাঁর সহধর্মিণীর নামেও নামকরণ করা হয়েছে একটি রাজপথের। ভারতের প্রাণ রসায়নের জনক বীরেশচন্দ্র গুহ (Biresh Chandra Guha) জন্মেছিলেন ১৯০৪ সালের ৮ জুন অবিভক্ত ময়মনসিংহে। অধুনা বাংলাদেশ। পরবর্তীতে এই কলকাতা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, অনুসন্ধানী মন নিয়ে গবেষণা করে গিয়েছেন আজীবন মানবকল্যাণের স্বার্থেই।
নিজের জীবন দিয়ে নিজের সাধনা দিয়ে কাজ করে গেছেন। বাংলা ও বাঙালির কাছে এক কৃতবিদ্য, আদর্শনীয়। এই কারণেই যে সেই সময় নিজের অদম্য চেষ্টাতেই নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে কাজ করে গেছেন।