সলতে পাকানোর ইতিহাস
বোম্বেতে তখন শচীন দেববর্মনের রাজত্ব। তিনি কলকাতার এক নবাগত গীতিকারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন বোম্বের জগতের লোকজনদের। বললেন, ‘এই হচ্ছে কলকাতার মজরুহ সুলতানপুরি’। গীতিকার তো যথারীতি লজ্জায় পড়ে গেলেন। কিন্তু যখন দেখি বাংলা ছবির পঞ্চাশের দশকের সেরা ৫০টি গানের মধ্যে প্রথম পাঁচটি গানই এই গীতিকারের লেখা; গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু (অগ্নিপরীক্ষা), ওগো তুমি যে আমার (হারানো সুর), এ শুধু গানের দিন (পথে হল দেরি), এই রাত তোমার আমার (দীপ জ্বেলে যাই), আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা (সাগরিকা); তখন মনে হয় শচীনকর্তার বিশেষণটি অতিশয়োক্তি নয়। ৫০-৬০ ও ৭০ দশক জুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য। শুধু ছবিতেই নয়, বেসিক রেকর্ডেও। সেই গীতিকার হলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। জন্মের শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করি তাঁর লেখা গানেই ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে’।
আরও পড়ুন-অসমে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৭, ক্ষতিগ্রস্ত ৪ লক্ষ
সংক্ষেপে জীবনকথা
গৌরীপ্রসন্নের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার হাতছানি ছিলই। স্বপ্নপূরণের সমস্ত আয়োজনও সম্পূর্ণ ছিল। অধ্যাপক বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারের কৃতী সন্তান, প্রেসিডেন্সির ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের ছাত্র অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য লাভের রামধনু গৌরীপ্রসন্নের আকাশ জুড়েই ছিল। তবু সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সাহিত্য চর্চার অলিন্দে পা রেখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন সেই তারুণ্যে ভরা দিনগুলিতে। ১৯২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনায় গৌরীপ্রসন্নের জন্ম। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র গৌরীপ্রসন্নকে সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করত সঙ্গীত। তাঁর এক কাকা জে এন তালুকদার বিলেত থেকে এনে দিয়েছিলেন গ্রামাফোন তাঁর মা সুধাদেবীকে। গ্রামাফোনের গান শুনতে শুনতে গৌরীপ্রসন্ন সঙ্গীতের মধ্যেই প্রাণের ছোঁয়া পেলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় সঙ্গীত শিল্পী বিমলভূষণের কাছাকাছি এসেছিলেন। গৌরীপ্রসন্নের লেখা দুটি গান বিমল ভূষণ রেকর্ডে গাইলেন ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে : ‘আমি বুঝতে পারি না কি আছে তোমার মনে’ এবং ‘শুধু পত্র ঝরায় অলস চৈত্র বেলা’। ১৯৪৭ সালে ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে গান লিখলেন। সুযোগ পেলেন প্রিয়তমা, অরক্ষণীয়া, স্বামী, শ্রীতুলসী দাস ছবিতে গান লেখার। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি ছবির গান ও বেসিক রেকর্ডের গানের জগতে স্বনামধন্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে স্কুলে ছাত্র! আতঙ্কিত অন্য পড়ুয়ারা
কিছু স্মরণীয় ঘটনা
অগ্রদূত গোষ্ঠীর পরিচালনায় তৈরি হচ্ছে ‘অগ্নিপরীক্ষা’। সুচিত্রা সেনের গানের প্রথম কলি ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। নেপথ্য গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা এবং অনুপম ঘটকের সুরে সেই গান। সিঁথির মোড়ে অধুলালুপ্ত এমপি স্টুডিওতে এই ছবির গান রেকর্ডিং চলাকালীন অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রধান বিভূতি লাহা এই সুরে একদম খুশি হতে পারলেন না। উনি রীতিমতো হম্বিতম্বি করে অনুপম ঘটককে বললেন, ‘এটা কি গান হয়েছে?’ তখনকার দিনের সঙ্গীত পরিচালকদের যথেষ্ট মেরুদণ্ড ছিল। তিনি বললেন, ‘আপনি কী করবেন আপনি ভাবুন। আমি এই সুর নিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্ট।’ গোষ্ঠীর অপর পরিচালক যতীন দত্ত যিনি সাউন্ড রেকর্ডিস্টও বটে, তিনি বললেন তাঁর এই সুর ভাল লেগেছে। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বলছেন ‘গানটির কুহু কুহু শব্দের এক জায়গায় সন্ধ্যার কণ্ঠে যে tremoto বা কম্পন তা ভীষণ ভাল লেগেছে।’ গানটির প্রশংসায় যতীন দত্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অনুপম ঘটক মুক্তকণ্ঠ। শেষ পর্যন্ত বিভূতি লাহা মেনে নিলেন তাঁদের কথা। বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন-শারীরিক অবস্থার অবনতি, গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়া
শিল্পী সংসদের ফাংশনে উত্তম- সুপ্রিয়ার দ্বৈত কণ্ঠে গান
১৯৬৮ সালে মহানায়ক প্রতিষ্ঠা করলেন শিল্পীদের নিজস্ব সংগঠন ‘শিল্পী সংসদ’। তৎকালীন মেয়র গোবিন্দ চন্দ্র দে-র বন্যাত্রাণের অনুষ্ঠানে উত্তম-সুপ্রিয়া গাইবেন। দর্শকদের উপযোগী করে গান লিখলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, ‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’। সুরকার নচিকেতা ঘোষ। ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে নিয়মিত রিহার্সাল। ১৯৬৮ সালের ১৯ নভেম্বর রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন গীতিকার স্বয়ং। দর্শকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস সেইদিন যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। তখন তো রেকর্ডিং করে রাখার কোনও সুবিধা ছিল না। থাকলে সেটা একটা দারুণ দলিল হয়ে থাকতে পারত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য করি, এই গান নচিকেতা ঘোষ আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়েও গাইয়াছিলেন পুজোর বেসিক রেকর্ডে।
বাংলাদেশের জন্য গান
তখন সবে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। সেই উপলক্ষেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হল গৌরীপ্রসন্নের লেখা গান। যে গানের প্রথম কলি ‘একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’। এর সুরকার এবং গায়ক অংশুমান রায়। বাংলাদেশের বেতারের জন্য তিনি গান লিখলেন, ‘মাগো ভাবনা কেন আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’। গানটির সুরকার এবং গায়ক হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-প্রচারে শোনা সমস্যার সমাধান হবে আগে : সায়নী
কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার গৌরীপ্রসন্ন
এ-কথা গরিষ্ঠ সংখ্যক পাঠক জানেন না যে ছবিতে গীতিকার হিসেবে যাঁর এত খ্যাতি, তিনি বাংলা ছবির জন্য বেশ কয়েকবার কাহিনি লিখেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। উত্তমকুমার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘শুধু একটি বছর’ (১৯৬৬)। তার কাহিনিকার গৌরীপ্রসন্ন। জমজমাট গল্প। সেইসঙ্গে উত্তম-সুপ্রিয়ার পাল্লা দেওয়া অভিনয়। ছবির জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। ছবির নাম ‘ছায়া সঙ্গিনী’। সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত অগ্রদূত পরিচালিত সাড়া জাগানো ছবি ‘সূর্যতোরণ’ (১৯৫৮), এর কাহিনিকার গৌরীপ্রসন্ন। অগ্রদূত পরেও গৌরীপ্রসন্নের কাহিনি নিয়ে আরও তিনটি ছবি পরিচালনা করেছেন। উত্তমকুমার সন্ধ্যা রায় অভিনীত ‘সূর্যতপা’ (১৯৬৫), উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘চিরদিনের’ (১৯৬৯) এবং উত্তমকুমার অভিনীত ‘সূর্যসাক্ষী’ (১৯৮১)। এর পাশাপাশি দীনেন গুপ্ত পরিচালিত রঞ্জিত মল্লিক ও অপর্ণা সেন অভিনীত ‘প্রক্সি’ (১৯৭৭)-র কাহিনিকার গৌরীপ্রসন্ন। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নন্দন’ ছবির (১৯৭৯) কাহিনিকার গৌরীপ্রসন্ন। বলাবাহুল্য এসব ক’টি ছবির সুরকার ভিন্ন ভিন্ন হলেও গীতিকার তো সেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
ব্যক্তিগত পরিচয়
প্রথম ছবি অগ্রদূতের ‘বাদশা’ (১৯৬৩)-তে যখন শিশুশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছি, তখন একদিন বিভূতি লাহা বাবাকে ফোনে জানালেন ছেলেকে নিয়ে অধুনালুপ্ত টালিগঞ্জের রাধা ফিল্মস স্টুডিওতে আসার জন্য। গেলাম বাবার সঙ্গে। ঢুকে দেখি সেই অফিস ঘরে তিন-তিনজন মানুষ সবাই ছ-ফুট লম্বা! বিভূতি লাহা নিজে, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জানতে চাইলেন গান গাইতে জানি কি না। শোনালাম গান। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর দেওয়া সেই সময়ের জনপ্রিয় গান ‘ভুল সবই ভুল’। ছবি ‘অতল জলের আহ্বান’। গীতিকার-সুরকার দু’জনেই বাহবা দিলেন। সেদিন একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, গৌরীপ্রসন্ন বিভূতি লাহার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছিলেন ছবিতে কোন কোন সিচুয়েশনে গানগুলি আসছে। এই যে মন দিয়ে শুনলেন, সেটাকে তিনি ব্যবহার করেছেন ছবির মধ্যে। গানগুলি অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমার লিপেই ছিল ‘লালঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না’, ‘শোন শোন মজার কথা ভাই’, ‘এই মজার মজার ভেলকি দেখো’ গানগুলি। নেপথ্য গায়িকা হেমন্ত-কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে স্কোরিং রুমে গান রেকর্ডিংয়ের দিন আবার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল সুধীর মুখোপাধ্যায়ের ‘নতুন তীর্থ’ (১৯৬৪) ছবির গান রেকর্ডিং-এর সময়। আমার লিপেই ছিল ছবির দুটি গান ‘আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই’, ‘দুঃখ যদি না আসে রে’। গায়িকা রাণু মুখোপাধ্যায়। গান দুটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন। সুরকার হেমন্ত।
আরও পড়ুন-নেতৃত্বে কাকলি, শুরু ২১-এর প্রস্তুতি
গৌরীপ্রসন্ন-নীতা সেন জুটি
একসময় গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও সুরকার নীতা সেনের সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক সংবাদ বিভিন্ন ফিল্ম ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেয়েছিল। নীতা সেন সুরারোপিত ছবিগুলির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন হওয়াতেই এই গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। বিশেষ করে ‘বাবা তারকনাথ’ ছবির গানগুলি যখন লোকের মুখে মুখে, রেডিওতে, রেকর্ডে শ্রোতাদের তোলপাড় করে তুলেছিল তখনই এই গুঞ্জন প্রকট হয়ে উঠেছিল। অথচ নীতা সেন এবং গৌরীপ্রসন্ন দু’জনেই বিবাহিত! সে-দিকটি কেউ খেয়ালই করেননি। একইভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই জুটির ‘কৃষ্ণসুদামা’, ‘সতী সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সোনার বাংলা’, ‘জঙ্গল পাহাড়ি’ প্রভৃতি ছবির গানগুলি। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি হল মৃত্যুশয্যায় গৌরীপ্রসন্নের লেখা শেষ গানটির প্রথম কলি ‘আমি কি আর ভাল হব না ডাক্তার রায়?’ মান্না দে-র স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘গানটি আমার গাওয়া গৌরীবাবুর শেষ গান শুধু নয় তাঁর জীবনেরও তো শেষ গান। রোগশয্যায় শুয়ে সত্যি সত্যি তিনি ভাবতেন আমি কি আর ভাল হব না!’ এই গানটির সুরকার হলেন নীতা সেন। গৌরীপ্রসন্নের শেষ অনুরোধে এই গান গেয়েছিলেন মান্না দে। গানটি যখন রেকর্ড হয় তখন তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলেও গেছেন। মান্না দের স্বীকারোক্তি, ‘গানটি রেকর্ড করার সময় বারবার গৌরীবাবুর সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল গৌরীপ্রসন্ন বারবার ওই প্রশ্ন করেছেন আমি কি আর ভাল হব না। সেই গান রেকর্ডের সময় শেষ অবধি আমি ভাল করে গাইতেই পারিনি, গলা বারবার বুজে আসছিল ব্যথায়, চোখের জলের প্লাবনে।’ প্রসঙ্গত বলা যায়, মান্না দে-র প্রথম বেসিক রেকর্ডের গান দুটি ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ (১৯৫৩)। পরের বারের রেকর্ডের গান দুটিও গৌরীপ্রসন্নের লেখা ‘তুমি আর ডেকো না’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর’।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
গানটির জন্মমুহূর্তের কথা জানিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সঙ্গীত পরিচালক সুপর্ণকান্তি ঘোষ। তখন তিনি নিউ আলিপুরে থাকেন। কয়েক দিন বাদে এম কম পরীক্ষা। পাশের ঘরে পুজোর গান লেখার জন্য বসে আছেন গৌরীপ্রসন্ন। তখন গৌরীপ্রসন্ন সুপর্ণকান্তিকে বলছেন, ‘কিরে তোর বাপের বয়সি মানুষটাকে বসিয়ে রেখেছিস। তোর কী আক্কেল! নাকি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বিড়ি সিগারেট খাচ্ছিস আর আড্ডা মারছিস!’ ওই আড্ডার কথা শুনে সুপর্ণকান্তির মাথায় একটা দারুণ আইডিয়া এসে যায়। তিনি বললেন ‘গৌরীকাকা একটা নির্ভেজাল আড্ডার গান লেখো তো, যা সবাইকে নাড়া দেয়।’ সেই প্রসঙ্গেই তিনি লিখলেন আলিপুরের বাড়িতে বসেই কফি হাউসের আড্ডার গানটি। কফি হাউসের আড্ডা, সোনালি সোনালি দিন, সেই দিনের অন্তিম পরিণতি, পঞ্চাশের দশকের তেজি তরুণ যুবকদের সময়ের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণের কথা লিখতে গিয়ে তিনি যেমন আমাদের জানিয়েছেন নিখিলেশ-সুজাতার কথা, তেমনি তিনি লিখেছেন ব্যর্থ প্রেমিক রমা রায় কিংবা ব্যর্থ কবি অমলের কথাও। ‘কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে/ পাগলা গারদে আছে রমা রায়/ অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যানসারে/ জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়।’ মৃত্যুর বছর চারেক আগেই এই গানটি লেখা। তাহলে কি গৌরীপ্রসন্ন জেনেই গিয়েছিলেন তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কথা এবং তাঁর মৃত্যুর আসন্ন বাণী। সেই কারণেই কি ব্যর্থ কবি অমলের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবরটুকু তিনি দিয়ে গেলেন সবাইকে।
আরও পড়ুন-আজ জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা
চোখের জলের বাণী
শচীন দেববর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র, নীতা সেন থেকে শুরু করে রাহুল দেববর্মন পর্যন্ত বিশিষ্ট সুরকারদের সৃষ্টিতে রয়েছে গৌরীপ্রসন্নের গান। অসংখ্য জনপ্রিয় ছবির গীতিকার তিনি। বাংলার সব বিখ্যাত শিল্পীরা গেয়েছেন তাঁর লেখা গান। পাশাপাশি লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলেও রয়েছেন। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে গৌরীপ্রসন্নের লেখা কিছু গানের অন্তরা বা সঞ্চারী থেকে বাণী তুলে ধরছি, তা থেকে বোঝা যায় তিনি এই পৃথিবীকে কতই না ভালবাসতেন: ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’ (শ্যামল মিত্র)। ‘আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)। ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখ হিসাব-নিকাশ কিছুই রবে না’ (শ্যামল মিত্র)। ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়)। ‘আজ আছি কাল কোথায় রব’ (আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়)। ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে সেই জীবনী লিখে রেখ তোমাদের গানের খাতায়’ (সতীনাথ মুখোপাধ্যায়)। ইন্টারনেটের কল্যাণে বহু গান পাওয়া গেলেও সেখানে গীতিকারদের নাম অনূক্ত থাকায়, একসময় গৌরীপ্রসন্নের বহু বিখ্যাত গান প্রচলিত সঙ্গীত হয়ে যাবে অথবা অদক্ষ গবেষকের কলমের আঁচড়ে তা হয়েও যেতে পারে অন্য কোনও গীতিকারের সম্পদ।