মুঙ্গেরিলাল কি হাসিন সপনের কথা মনে আছে? নবপ্রজন্মের মনে না পড়লেও নব্বই দশকের অনেকেরই মনে রীতিমতো দাগ কেটে গিয়েছিল মুঙ্গেরিলাল কি হাসিন সপনে সিরিয়ালটি। সিরিয়ালের মুখ্যাভিনেতা রঘুবীর যাদব ওরফে মুঙ্গেরিলাল জেগে স্বপ্ন দেখতেন। দিবা স্বপ্ন আর কি! স্বপ্নে তাঁর দজ্জাল স্ত্রী, খিটখিটে অফিসের বস আর পুলিশ শ্বশুরকে বেজায় ঢিট দিতেন। কখনও সুন্দরীদের সঙ্গে ডেটেও যেতেন। তবে স্বপ্নের শেষটা বড় মর্মান্তিক। যথারীতি মুঙ্গেরিলালের অপছন্দের স্বজনেরাই তাঁর ঘুম ভাঙাত।
মুঙ্গেরিলালের আজব স্বপ্ন অবশ্য উপভোগ করত পর্দার অপর প্রান্তে থাকা দর্শক। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্নের মতো। গঞ্জিকা সেবন করিয়া স্বপ্ন দেখা। যাতে দিনরাত কিছুই মালুম পড়বে না। দিবাতেও মনে হবে ভোররাতের স্বপ্ন দেখছি৷ আর এই অবাস্তব, গুলবাজির স্বপ্নে মশুগুল রাজ্য বিজেপির নেতারা৷ রাজ্য রাজনীতির সিরিয়াস কর্মকাণ্ডের মাঝে বিজ্ঞাপনের বিরতির মতো বেশ রিলিফের কাজ করে বিজেপি নেতাদের গালগল্পে ভরপুর এন্টারটেইনমেন্ট। টিভিতেও বিজেপি নেতাদের ‘গল্পদাদুর আসর’ বেশ জমে যায়। সেখানে গ্যাস বেলুন, ফানুসের রকমারি আইটেম হাজির। মুখের মারিতং জগতংয়ে পারলে এখনই নবান্ন জয়ের দাবি। এতে ভরপুর হাওয়া দেন দিল্লির মন্ত্রীসান্ত্রিরা।
আরও পড়ুন-দুর্নীতি ফাঁস হতেই নাটক শুরু বিজেপি কাউন্সিলরের
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সেই স্বপ্নের ‘ঘোড়ার ডিম’য়ে ভালই ‘তা’ দিয়ে গিয়েছেন। আর তাতে এখানকার আহাম্মক বিরোধীরা একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ধেই ধেই করে নাচছেন। এই ফ্যান্টাসি শেষ হবে ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর দিন। বস্তুত, চূড়ান্ত খারাপ ফল করে নিজেদের এই দিবাস্বপ্নে গামলা গামলা জল ঢালবেন নিজেরাই। তারপর মুখ চুন করে গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়ার পালা।
বিগত কয়েক বছর ধরে এই অ্যাকশন রিপ্লে অবিরাম চলছে। এক ক্যাসেট বাজানোর মতো। বুথ পর্যায়ে যে দলের সংগঠনের আগাপাশতলা নেই তারা ফের দুশো পারের কুমির ছানা বের করছে ঝোলা থেকে।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহজির আবার মুদ্রাদোষ দাঁড়িয়ে গিয়েছে, কথায় কথায় ‘কান খোল কে শুন লো’ বলাটা। মন্ত্রিমশাই মার্জনা করবেন, আপনার মনে হয় কানে বেজায় খোল জন্মেছে। সেজন্য বারংবার ভুল শুনছেন, ভুল বুঝছেন এবং সর্বোপরি ‘ভাট’ বকছেন। এই তো গতবারও মানে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে আপনি বলেছিলেন, ইস বার ২০০ পার। বিজেপি হয়েছিল পগারপার। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে একটা সময় তো বাংলায় বিজেপিকে ৩০-৩৫টা আসন পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো আরও এককাঠি ওপরে। তিনি বলেছিলেন, ২০২৪-এ বিজেপি নাকি সারাদেশের মধ্যে সবথেকে ভাল ফল করবে পশ্চিমবঙ্গে। অথচ ফল বেরনোর পর দেখা গেল ২০১৯-এই সবেধন নীলমণি ১৮টা আসন থেকে ৬টা আসন কমে ১২-এ নেমে এসেছে বিজেপি।
নির্বাচন কমিশনের বদান্যতা এবং বিপুল টাকা ছড়িয়ে দু’অঙ্ক ধরে রাখতে পেরেছিল বিজেপি। নচেৎ সঠিক ফলাফল হলে বিজেপি ৬-৭-টার বেশি আসন কিছুতেই পেত না।
অর্থাৎ, ফলেন পরিচয়ে কী হল? অশ্বডিম্ব প্রসব। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন, তার উল্টোটাই ধরে এগোতে হয়। নিজের নাম, পদের প্রতি এতটা অমর্যাদা নাই বা করলেন আপনারা।
অমিত শাহজি, আপনি না দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! সব বাঘা বাঘা এজেন্সি, বাহিনীর মাথা। নিজেই যদি এত প্রলাপ বকেন তাহলে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা তো তলানিতে ঠেকবে। এজেন্সির সাফল্যের হার যে ভগ্নাংশে ঠেকেছে সেও মনে হয় এই আগডুমবাগডুম বকবকানির জন্য।
আরও পড়ুন-‘দিদিকে বলো’তে ফোনে নদীভাঙন সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন কৃষকেরা
এই যে বাংলা এবং তামিলনাড়ু জয়ের কথা বলছেন। নিজের গায়ে একটু চিমটি কেটে দেখুন তো ঠিকঠাক বলছেন, না স্বপ্নের ফুলঝুরি ঝরাচ্ছেন। বাংলায় যে বিজেপি নেতারা আবোলতাবোল বকছেন তাঁদের কথা তাও মানা যায়। সংগঠনবিহীন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঘ, বুথে ইঁদুর নেতারা না-হয় মানসিক অবসাদে ভুগছেন। যেমন বিরোধী দলনেতা ‘আহাম্মক’ অধিকারী তেমন তাঁর টিম। বেলতলায় বারবার গিয়ে নাক-কান কাটা ‘বাতেলা’ বাগচী, ‘অচল’ ঘোষ, আরও কয়েকজন ‘চারআনার নকুলদানা’। এদের সঙ্গে কতগুলো ফেরেববাজ ইউটিউবার। আরশোলা যদি পাখি হয় তাহলে এই গোমূর্খগুলোও সাংবাদিক।
কিন্তু তা বলে দেশের অভিভাবক দাপুটে মন্ত্রীরাও এই অর্ধ-উন্মাদদের কথায় তাল মেলাবেন! এখানেই তো তালটা কাটছে। তাল বেতাল হয়ে মহারাজ বিক্রমাদিত্যর কাঁধে চাপছে, আরে ছেলে ভোলানো ললিপপ দিচ্ছে। অন্ততপক্ষে, রাজ্যে বিজেপি দলটা যাতে পুরোপুরি উঠে না যায় সেজন্য হয়তো ভোকাল টনিক দিতে হচ্ছে। প্রবল শক্তিশালী বোখুমের বিরুদ্ধে নামার আগে ভারতের কোচও কী গোহারান হেরে যাওয়ার কথা বলেছেন? যদিও মনের ভিতর ধুঁকপুকানি থেকেই গিয়েছিল ০-৫ হবে না ০-৬। ১০-১২ গোলের মালা পরতে হবে না তো? এমতাবস্থায় বিজেপিকে লড়তে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে হিমালয়ের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের মধ্যে থেকে যাঁর উত্থান। সিপিএমের হাজারো অত্যাচার যাঁকে কক্ষচ্যুত করতে পারেনি। সিপিএমের হার্মাদদের অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তিনি।
হিমালয়ের জন্য সাইবেরিয়ার বাতাস যেমন ভারতে ঢুকতে পারে না, ঠিক সেভাবেই গোবলয়ের গোয়েবলসদের ইতরামি, অসভ্যতা রুখে রাজ্যকে উন্নয়নের মোড়কে মুড়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্মীভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো অসংখ্য প্রকল্প সারা বছর বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতাকে স্নেহ-মমতার আঁচলে বেঁধে রেখেছে। আর করোনা থেকে আম্ফান, পাড়ার মানুষের আপদে বিপদে যে ছেলেপুলেগুলো জানপ্রাণ এক করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁরা কিন্তু সব তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী-সমর্থক। দলনেত্রীর নির্দেশে তাঁরা সারা বছর মানুষের পাশে থাকেন৷
হরিয়ানা, দিল্লি বা মহারাষ্ট্রে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বে অনেক অসঙ্গতি ঘটিয়ে সেখানকার ফলাফল আমূল পালটে দিয়েছে গৈরিক গরিলারা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশ্ছিদ্র পাহারায় ভূতুড়ে ভোটার ঢোকার অভিসন্ধি অঙ্কুরেই রুখে দেওয়া হয়েছে৷ ফলে এই মুহূর্তে ৬০-এর ঘরে থাকা বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ২৬-এর ভোটের পর যদি ৩০-এর ঘরে নেমেও আসে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।