মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “বাবাসাহেব আম্বেদকরকে নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে আমি স্তম্ভিত। বাবাসাহেবকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হলে খারাপ লাগে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনা বিজেপির দলিত-বিরোধী মনোভাবকেই সামনে এনেছে।” তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র সংসদের আম্বেদকর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন বাবাসাহেবকে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যের। অমিত শাহের এই কটূক্তি আসলে আম্বেদকর এবং দেশের দলিত-পিছড়েবর্গের মানুষদের সম্পর্কের সঙ্ঘ ও বিজেপির উচ্চবর্ণবাদী হিন্দুত্বের মনোভাবেরই প্রতিফলন। যা মোক্ষম সময়ে মুখোশ খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বিজেপি যতই তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং তাত্ত্বিক মুখোশের আড়ালে দলিত-নিম্নবর্ণের প্রতি তাদের উচ্চবর্ণীয় সমাজপ্রভু-সুলভ ঘৃণা লুকোনোর চেষ্টা করুক না কেন, সেই স্বাধীনতার সময় থেকে দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে তারা তাদের এই উচ্চবর্ণের আধিপত্যবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে।
আরও পড়ুন-কলেজে মারধরের পর কান ধরে ওঠবস, থুতু চাটানো হল যুবককে
কিন্তু আম্বেদকর মানেই কেবল দলিত-অধিকারের লড়াই নয়। কংগ্রেস আদৌ আম্বেদকরকে সম্মান দিয়েছে কিনা, নেহেরু সত্যিই আম্বেদকরকে কী চোখে দেখতেন, তা নিয়ে বিজেপির বিতর্কে যাবার কোনও অধিকার আছে কিনা, সেটা নিয়েই আগে প্রশ্ন তোলা জরুরি। সংবিধান রচনার কাজে কিন্তু আম্বেদকরের সঙ্গে ভারতীয় জনসঙ্ঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও যুক্ত ছিলেন। এই তিনজন একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা বজায় রাখতেন। যদিও শ্যামাপ্রসাদ আর আম্বেদকরের সমাজদৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। আজ অমিত শাহ যে ভাষায় আম্বেদকরকে নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, তা শ্যামাপ্রসাদের শিক্ষা ও রুচির সম্পূর্ণ বিরোধী। বলাই বাহুল্য আজকের বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে সেই সৌজন্য আশাও করা যায় না।
আম্বেদকর কংগ্রেস মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে আরএসএস এবং ভারতীয় জনসঙ্ঘের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে। এমনকী কংগ্রেসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাও এই প্রশ্নে আম্বেদকরের বিরোধিতা করেন এবং এক্ষেত্রে নেহেরু কঠোর অবস্থান নিতে পারেননি। আম্বেদকরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, রাজেন্দ্র প্রসাদ, পট্টভি সীতারামাইয়া, কে এম মুনশি, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন-সহ আরও অনেকেই। পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে সঙ্ঘ এবং হিন্দুত্ববাদীরা এতটাই রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক ছিল যে, তাদের নেতৃত্বে সাধু-সন্তের বিরাট বাহিনী সেদিন পার্লামেন্ট ভবন ঘেরাও করেছিল। আম্বেদকরের ভাবনায় নারী, শূদ্রের সমানাধিকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়ন, সার্বিক শিক্ষা, প্রান্তিক দলিত-আদিবাসী অংশের সার্বিক উন্নতির এক ব্যাপক স্বপ্ন ছিল মুখ্য। যা, সঙ্ঘ পরিবারের ব্রাহ্মণ-বানিয়ার সঙ্কীর্ণ স্বার্থে কাজ করা মতাদর্শের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আম্বেদকর বলেছিলেন— “ধর্মের কাজ সমস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো”, “ঈশ্বরের নিজের সুখ অর্জন ধর্মের চালিকাশক্তি নয়, মানুষের সুখই বরং ধর্মের চালিকাশক্তি”। এই ভাবনার ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিন্দু ধর্মের উচ্চবর্ণবাদী ব্যাখ্যার সূত্রে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট পাবার বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতি।
আরও পড়ুন-গেরুয়া সরকারের অপদার্থতা, অসমে অব্যাহত বাল্যবিবাহ
তবে, বাবাসাহেবকে ‘ভারতরত্ন’ কংগ্রেস দেয়নি এটা ঠিক। আম্বেদকরকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়েছিল বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর ‘জনতা সরকার’। সংসদ ভবনে বাবাসাহেবের ছবি বসানোর কৃতিত্বও তাঁর সরকারেরই। ভি পি সিং-ই দলিতদের জন্য সংরক্ষণকে এক বিরাট রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা দেন। তাঁর বিরুদ্ধেই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার নিজেদের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিকে নতুন উদ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ‘রামরথ’ পরিক্রমায় বেরোয় ও ১৯৯২ সালে প্রকাশ্য দিবালোকে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। শুরু হয় ‘মণ্ডল’ বনাম ‘কমণ্ডলু’র লড়াই। বাবাসাহেব জয়ন্তীকে দেশের ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করাও জনতা সরকারেরই কৃতিত্ব। কিন্তু অমিত শাহ যখন বলেন, কংগ্রেস বাবাসাহেবকে যথোচিত সম্মান দেয়নি, তখন তা প্রহসনের মতো শোনায়। কারণ, আম্বেদকরের মূল কথা ছিল সংবিধানের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো মান্য করা, ভূমিসংস্কার, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে জমির পুনর্বণ্টন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করা, প্রত্যেকের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণকে যথাযথ মর্যাদায় স্থাপন। এর একটাও কি মোদি সরকার বিগত সাড়ে দশ বছরে মান্য করেছে? করেনি। উলটে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি হুঙ্কার দিচ্ছিল ৪০০-র বেশি সিট নিয়ে ফিরলে সংবিধান বদলে ফেলবে তারা। বাবাসাহেব সমস্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থের বিরোধিতা করেছিলেন। উচ্চবর্ণের গোটা দেবতাগোষ্ঠীকে অস্বীকার করেছিলেন। ১৪ অক্টোবর, ১৯৫৬, নাগপুরে ‘ধম্মচক্র প্রবর্তন দিবস’-এ হাজার হাজার দলিত অনুগামীকে তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন এবং তাঁর ২২টি উপদেশ তিনি দান করেছিলেন তাঁদের, যার প্রধান কথা হল মানবতাবাদ, যা ছিল বুদ্ধের পথ। এর একটাও বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডায় নেই, উলটে অমিত শাহ আজ নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলে বাবাসাহেবকে প্রকাশ্যে অপমান করলেন, যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে গোটা দেশ।
আরও পড়ুন-সাংসদ দেবের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ আসানসোলের ছাত্রীর
১৯৯৭ সালে বিজেপির নেতা ও তাত্ত্বিক অরুণ শৌরি একটি বই লেখেন— ‘ওয়রশিপিং ফলস গডেস’। এই বইয়ে তিনি বাবাসাহেব আম্বেদকরকে নির্লজ্জ ভাষায় আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের পুরস্কারস্বরূপ তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় পান বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ পদ ও পরে ‘বিলগ্নীকরণ মন্ত্রকে’র দায়িত্ব। হরিয়ানায় ‘গুরগাঁও’-এর নাম বদলে বিজেপি সরকার রাখে ‘গুরুগ্রাম’। তারা প্রচার করে, ওই অঞ্চলটি গুরু দ্রোণাচার্যের শিক্ষাদানের ক্ষেত্র। দ্রোণাচার্য হলেন মহাভারতের সেই গুরু যিনি শূদ্র একলব্যের আঙুল কেটে নিয়েছিলেন।
ঠিক কোন দিনে এই নাম পরিবর্তনের কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল, জানেন? দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল, ২০১৬। বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিন। দলিতদের ইচ্ছাকৃত অসম্মান করার জন্যই ওই নির্দিষ্ট দিনটিকে বেছে নিয়েছিল বিজেপির মনোহরলাল খট্টরের সরকার।