ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক লুইস আলথুসারের লিখিত একটি গ্রন্থ ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় ‘আইডিওলজি অ্যান্ড আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’ নামে, গ্রন্থটি সারা বিশ্বের সমাজ চিন্তকদের মধ্যেই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। আজ ভারতবর্ষের রাজনীতির আঙিনায় যখন নিট ও নেটের দুর্নীতির বিষয়টা সামনে উঠে আসছে তখন এই গ্রন্থের বিষয়ের আলোকে রাষ্ট্র, তাঁর মতাদর্শ ও দুর্নীতির বিষয়টাকে অবলোকন করা বেশ যুক্তিসম্মত মনে হয়। লুইস আলথুসার বলেছেন, রাষ্ট্রকে আমাদের দুটো উপাদানে দেখতে হবে, প্রথমটি হল রাষ্ট্রক্ষমতা ও দ্বিতীয়টি হল রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করেছেন তিনি, প্রথমটি, দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস) এবং দ্বিতীয়টি, মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র (আইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাস)। আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতা অর্থাৎ সরকার এবং তার পরিচালিকা শক্তিসমূহকে গণতান্ত্রিকভাবে আমরা অপসৃত করতে পারি, মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রক্ষমতাকে সরিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, এখানেই লুইস আলথুসারের বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রশ্ন এখানেই, যে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও তাঁর দমন পীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র যার মধ্যে পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সি রয়েছে সেগুলোকে অপসৃত করা গেলেও মানুষের মনের যে দখল সেটা কি নেওয়া যায়? মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষের চেতনার স্তরে, ভাবনার স্তরে বাসা বাঁধে, যে চেতনার বীজ ভাবনার বীজ রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে বপন করে দেয় তাকে উৎপাটন করা খুব কি সহজ?
আরও পড়ুন-এগিয়েও কাপ অধরা মোহনবাগানের, যুবভারতীতে নর্থইস্ট রূপকথা
ইতিমধ্যেই নিট ও নেট দুর্নীতি নিয়ে সারা ভারতবর্ষের রাজনীতি সরগরম, একাধিক রাজ্য থেকে নিট দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, নেট পরীক্ষা হওয়ার পর বাতিল হয়ে গিয়েছে। এনডিএ জোট ২৯৩ জন সাংসদ নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হওয়ায় বিরোধী ইন্ডিয়া শিবির প্রথম থেকেই এনডিএ জোটকে চাপে রাখতে বদ্ধপরিকর। নিট ও নেট দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ সংসদের কক্ষেও শোনা গিয়েছে, শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনে শপথবাক্য পাঠ করার সময় বিরোধী শিবির থেকে ‘নিট নিট’ আওয়াজ উঠেছে। বিরোধী শিবিরের চাপে এবং শাসক দল তাদের ভাবমূর্তি যাতে প্রথম থেকেই ক্ষুণ্ণ না হয় তার জন্য হয়তো তদন্তের গতিপ্রকৃতিকে মসৃণ রাখার চেষ্টা করবে কিন্তু নিট ও নেট দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে আরও যে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে যা ওই মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্রের উপাদান, যার শিকড় কিন্তু অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।
যে দুটি পরীক্ষার দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে আজ গোটা দেশ উদ্বেলিত সেই নিট এবং নেট দুটি পরীক্ষার পরিচালক সংস্থাই হচ্ছে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ), যা ভারত সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক দ্বারা ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বশাসিত সংস্থা। এই এজেন্সির চেয়ারপার্সন পদে যিনি বসে রয়েছেন সেই প্রদীপকুমার জোশী, তিনি ইতিমধ্যেই ইউপিএসসির প্রধান এবং মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আরেকটি পরিচয়— তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপির পদেও ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থার উচ্চপদে আসীন হওয়ার পিছনে আরএসএসের বিভিন্ন প্রচারকের সুপারিশ প্রদত্ত হয়েছিল। এখানে এজেন্সি যাকে আলথুসার দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র বলেছেন সেই এজেন্সি সর্বভারতীয় এই পরীক্ষাগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করে, প্রশ্নপত্র তৈরির মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা পরিচালনার ভূমিকা নিচ্ছে। এই মতাদর্শ আর অন্য কোনও মতাদর্শ নয়, বিজেপি ও আরএসএস প্রচারিত হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ। ইউজিসি নেটের নাটক বিষয়ের পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে অযোধ্যার প্রাণপ্রতিষ্ঠার তারিখ, রামায়ণের শ্লোকে হনুমানের বর্ণনা, মহাভারতে মুণ্ডচ্ছেদ হওয়ার পরেও বেঁচে থাকার মতো বিষয়গুলো নিয়ে। এভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র তার হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শকে প্রবেশ করিয়ে দিতে চাইছে পরীক্ষার্থীদের চেতনার গভীরে।
আরও পড়ুন-নর্থ চ্যানেল জয় সায়নীর
উত্তরদানের ধাঁচটিও গড়া হয়েছে এমন ভাবে যেখানে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্লেষণী দক্ষতা প্রয়োগের কোনও সুযোগই নেই, একটি প্রশ্নের চারটি উত্তর, সেখান থেকে সঠিক উত্তরটি বেছে নিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়া এই প্রশ্ন যার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনও ছাত্র-ছাত্রীর যদি ভিন্ন মত, ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্ন বিশ্লেষণ থাকে তার দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র ও তার এজেন্সি যে মতাদর্শকে প্রোথিত করতে চায় তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করা আবশ্যক, নইলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে হবে।
নিট ও নেট পরীক্ষা হিমশৈলের চূড়ামাত্র, সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন শিক্ষা সংস্থাগুলো আজ হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ প্রচারের আয়োজক। কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের স্বশাসিত সংস্থা এনসিআরটি ২০২৩ সালে স্কুলের পাঠক্রমের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে, দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে মোগল অধ্যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে একাধিক অধ্যায়কে। শিক্ষা প্রাঙ্গণে এই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ প্রচারের উদাহরণ অজস্র।
আশঙ্কার বিষয় এটাই যে, হয়তো বিরোধী শিবিরের চাপে নিট ও নেট পরীক্ষার দুর্নীতির তদন্ত হবে, দোষীরা শাস্তিও পাবেন, দু-একটি উচ্চপদস্থ পদেরও রদবদল হবে, কিন্তু এই সবই তো দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপসারণের নামান্তর। মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে ছাত্র-ছাত্রী ও পরীক্ষার্থীদের মনের গভীরে প্রবেশ করছে, অন্ধ ধর্মীয় মতবাদে তাদের আচ্ছন্ন করছে, তাকে অপসারণ কি খুব সহজ?