প্রত্যাখ্যানের বাঁশি আকাশে বাতাসে, বিজেপি আর বাঁচবে কোন আশে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশে বিজেপির কোমর ভেঙে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সবুজঝড়কে যাঁরা ভোটলুঠ বলে লঘু করতে চাইছেন, তাঁরা আসলে ফের জনমন পড়তে ব্যর্থ। মূর্খের স্বর্গের সেইসব বাসিন্দাকে এবারের উপনির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলেন দেবু পণ্ডিত

Must read

এত লম্ফঝম্প। এত আস্ফালন। এরপরেও এমন বেহাল দশা! অঙ্কটা মিলছে না কিছুতেই। সত্যিই কি তাই? নাকি অঙ্কটা মিলেছে। কিন্তু উত্তরটা ঘুলিয়ে দেওয়ার জন্যই এত লম্ফঝম্প, আস্ফালন, হুঙ্কার? শূন্য কলসির আওয়াজ?
এই কথাগুলো উঠছে লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রকাশিত বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা উপনির্বাচনের ট্রেন্ড দেখে।

আরও পড়ুন-বৃক্ষনিধন: দিল্লির এলজির তীব্র নিন্দা সুপ্রিম কোর্টের

প্রথমেই আসা যাক মানিকতলার কথায়। জোড়াফুলের জেতা আসন। গত লোকসভায় কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের অন্তর্গত এই বিধানসভা আসনেও লিড পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানেই এবার প্রার্থী আগের বার এই কেন্দ্র থেকে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হওয়া স্বর্গত সাধন পাণ্ডের বিধবা পত্নী সুপ্তি দেবী। বিপক্ষে সাধন পাণ্ডের কাছে পরাস্ত এবং সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে হার স্বীকার করা পদ্মপ্রার্থী কল্যাণ চৌবে। ফলে অ্যাডভান্টেজ জোড়া ফুল ছিলই। কাঁটার মতো খচখচ করছিল ৩১ নম্বর ওয়ার্ড। কাউন্সিলর বেলেঘাটা কেন্দ্রের বিধায়ক পরেশ পাল। ভোটের আগে মানিকতলা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে দিলেন একটা কমিটি। ভোট পরিচালন কমিটি। সেখানে সদস্য পরেশ পাল। কো- অর্ডিনেটর কুণাল ঘোষ। ব্যাস! খেলা শেষ। ভোটের দিন দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত সেনাপতিরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গণতন্ত্রের উৎসব দেখছেন। আর ভোটের কয়েকদিন আগেই পদ্ম প্রার্থী গতিক সুবিধার নয় টের পেয়ে কুণাল ঘোষকেই ফোন করে বসলেন সাহায্য প্রার্থনা করে এবং সেই সঙ্গে তাঁকে ক্রীড়া সংস্থার পদাধিকারী করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে। তখনই বোঝা গিয়েছিল, হারের হ্যাট্রিক হুতে চলেছে পদ্ম কল্যাণের। ফল, সেই উপলব্ধিতেই সিলমোহর দিল। ৬২ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী সুপ্তি দেবী। স্বামীর অসমাপ্ত উন্নয়নকে তিনিই এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এমনটাই বিশ্বাস মানিকতলার মানুষের।

আরও পড়ুন-পরপর বিপত্তি! এবার লক্ষাধিক টাকার মহাপ্রসাদ নষ্টের অভিযোগ সেবায়েতের

কেন এই বিপুল ভোটে হার? কেন লোকসভার ফলাফলকে ছাপিয়ে এবারের এই জয়োল্লাস? কেন জগাই মাধাই গদাইদের কুৎসা অপপ্রচার এজেন্সি রাজনীতির নোংরামি সত্ত্বেও মানিকতলা কেন্দ্রে এই ঐতিহাসিক জয়?
কারণ নং ১
প্রার্থী নির্বাচনে মাস্টার স্ট্রোক। সাধন-পত্নী সুপ্তিতেই আস্থা জ্ঞাপন। সাধন পাণ্ডের প্রয়াণের পর বিধায়কহীন মানিকতলা নিরন্তর পাশে পেয়েছে দলগতভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে, ব্যক্তিগত ভাবে সুপ্তি-শ্রেয়া, মা-মেয়ের জুটিকে। মানিকতলা সেকথা ভোলেনি।
কারণ নং ২
বিজেপির প্রার্থী নির্বাচনে দুর্বলতা। হেরো মুখের ওপর এবারেও ভরসা রাখা।
কারণ নং ৩
জোড়াফুল শিবিরের জনভিত্তির উল্টোদিকে পদ্মফুল শিবিরের জনবিচ্ছিন্নতা। বুথে এজেন্ট বসানোর মতো কর্মী নেই বিজেপির। বিজেপি প্রার্থীকে কে কবে মানিকতলায় মানুষের পাশে দেখেছে? এমনই প্রার্থী যাঁর মায়ের ভোট দানে অসুবিধা ঘোচাতে এগিয়ে আসতে হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টকে। অর্থাৎ, নিজের মায়ের পাশে দাঁড়ানোর মুরোদ পদ্ম প্রার্থীর ছিল না। তাঁর মায়ের আস্থাও জোড়া ফুল শিবিরের ওপর। সাধারণ মানুষ ব্যতিক্রম হবেন কেন?

আরও পড়ুন-বৃক্ষনিধন: দিল্লির এলজির তীব্র নিন্দা সুপ্রিম কোর্টের

কারণ নং ৪
বামপ্রার্থী প্রথম থেকেই নুইয়ে পড়া। লড়াইয়ে দুধভাত। শ্রমজীবী মানুষের জন্য লড়াই করছে কেবল তাঁর দল, এমন গতে বাঁধা বিপ্লবী বুলি সম্বল করে নেতা হয়ত হওয়া যায়, ভোটে জেতা যায় না। এটা তিনি এবার ভালমতোই বুঝেছেন। যেটা বোঝেননি, সেটা হল, ৩৪ বছরের জমানার সময়ে এই কেন্দ্রের মানুষ যে রাজনৈতিক পরম্পরার ওপর আস্থা রেখেছেন, বিগত ১৩ বছরের প্রশাসনিক পরিষেবা সেই পরম্পরায় আরও গতি শক্তি ও সামর্থ্য সংযোজন করেছে। ফলে জনভিত্তিতে ক্ষয় নয়, বরং সেটা আরও মজবুত হয়েছে।
কারণ নং ৫
কল্যাণের কীর্তি তৃণমূল কংগ্রেসকে আরও এগিয়ে দিয়েছে। হেরো কল্যাণ মামলা করে মানিকতলার মানুষকে বিধায়ক-পরিষেবা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন। তাঁর কারণেই এই কেন্দ্রে সাধন পাণ্ডের প্রয়াণের পর উপনির্বাচন হয়নি। যিনি মানুষকে ভোট দিতে দেননি, মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন কেন? সুতরাং, যা হওয়ার তাই হয়েছে।
কারণ নং ৬
সংগঠন নেই। জন সমর্থনও নেই। লোকসভায় মোদির হাল দেখার পর যেটুকু ছিল, সেটুকুও গেছে। মানুষ কখনও হেরোকে আঁকড়ে আগামী রচনা করে না। জয়ী পক্ষেই নিজেকে জুড়তে চায়। সেই আগ্রহেই গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন।
রায়গঞ্জ, রানাঘাট এবং বাগদা কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও মোটামুটি অভিন্ন কারণে বিজেপি পর্যুদস্ত এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল ভোটাধিক্যে জয়। রানাঘাট দক্ষিণ ও বাগদা, এই দুই কেন্দ্রে এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মতুয়া সমাজের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে পুনঃ আস্থা জ্ঞাপন। আর রায়গঞ্জের ফল বুঝিয়ে দিল, উত্তরবঙ্গে বিজেপিতে মোহভঙ্গের যে ট্রেন্ড লোকসভা নির্বাচনে শুরু হয়েছিল, সেই ধারা আরও স্পষ্ট ও গতি প্রাপ্ত হয়েছে এই উপনির্বাচনে। ফলে,উত্তর থেকে দক্ষিণ চার বিধানসভা আসনেই জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস।
পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়।

আরও পড়ুন-শুনশান ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের জয়

সাত রাজ্যের উপনির্বাচনে ১৩টি আসনের মধ্যে ১০টিতে জিতেছে অ-বিজেপি প্রার্থীরা। হিমাচল প্রদেশের হামিরপুর আর মধ্য প্রদেশের অমরওয়ার ছাড়া বিজেপি আর কোথাও দাঁত ফোটাতে পারেনি। এই যখন সারা দেশের ছবি, তখন পশ্চিমবঙ্গে পৃথক চিত্রের স্বপ্ন কে বা কারা দেখেছিলেন, কে জানে!

Latest article