কলকাতা নিরাপদতম শহর ঘোষিত হয়েছে কেন্দ্রের রিপোর্টে। সেটা তুলে ধরে বিজেপিকে চড়া সুরে বিঁধেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে মহিলারা সুরক্ষিত, তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত। মহিলাদের উন্নতি, অগ্রগতি অব্যাহত। তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলা হচ্ছে। বাংলায় মহিলারা স্বাবলম্বী। তাঁদের আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী সরকার। কলকাতা নিরাপদতম শহর বলেই এটা আরও সহজ হচ্ছে। বিপরীতে, দিল্লি শহর মহিলাদের জন্য রীতিমতো বিপজ্জনক। উত্তরপ্রদেশ-সহ ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারগুলির কোনওটিই মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়।
ভুল কিছু বলেননি শশীদেবী।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃকপাত করলেই ব্যাপারটা ভালমতো বোঝা যাবে।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে মহিলা নির্যাতনের একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ, উত্তরপ্রদেশে এক মহিলার উপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছে। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত বিজেপির আইটি সেলের দুই সদস্য। ওই বিজেপি
(BJP States) কর্মীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অথচ বিষয়টি সম্পর্কে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নীরব! কোনও কড়া পদক্ষেপ করা হয়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এসব থেকে একটা কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মহিলাদের সম্মান দিতে চায় না বিজেপি। মণিপুরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। বিজেপি নেতৃত্ব তাতে কর্ণপাত করেনি।
পরীক্ষায় প্রথম তিন স্থানাধিকারীকে নিয়ে গর্ব করা চেনা দস্তুর। যে কোনও প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়কে কুরনিশ জানানোই সমাজের চেনা ছবি। কিন্তু এই চেনা ছবির সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির জমানায়। শিশুদের যৌন নির্যাতনের মামলায় বিচারের জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ‘প্রটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেনসেস’ বা পকসো আইন চালু আছে। নিজেদের সদিচ্ছা বোঝাতে আরও কঠোর পদক্ষেপ করার অভিপ্রায় নিয়ে ২০১৯ সালে পকসো আইন সংশোধন করে মোদি সরকার। তবু দেশ জুড়ে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে! আর এই নির্যাতনের ঘটনায় দেশের মধ্যে প্রথম তিনটি স্থানে রয়েছে মোদির তিন ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্য। খুব সম্প্রতি সংসদে যে-তথ্য পেশ করেছেন কেন্দ্রের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী, তাতে বলা হয়েছে, শুধু ২০২১ সালে পকসো আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে বিজেপির ‘পোস্টার বয়’ যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে। তার পরের দুটি স্থান দখল করেছে ডাবল ইঞ্জিনের আর দুই রাজ্য মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ‘ডাবল’ ইঞ্জিনের তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছে গেরুয়া শিবির। সোজা কথায়, কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে উন্নয়নের কাজ ঝড়ের গতিতে এগোবে। প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মূলত এই স্লোগান সামনে রেখে লড়াইয়ে নামে মোদি বাহিনী। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো পদ্ম শিবিরের ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের প্রকৃত চেহারাটা বেআব্রু করে দিয়েছে শিশু নির্যাতনের এই তথ্য। কেবল শিশু নয়, নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির (BJP States) হাড়হিম করা ঘটনা গোটা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন-বাম জমানার নিয়োগ দুর্নীতির প্যান্ডোরা বক্স খুলে দিল কোর্ট
দেশের ১৮ বছরের কম বয়সিদের শিশু হিসাবে গণ্য করে তাদের যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১২ সালে তৈরি হয় পকসো আইন। এই আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে কয়েক বছরের সাজা ঘোষণার কথাও বলা আছে। কিন্তু দেশ জুড়ে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুন ও যৌন নির্যাতন বা লালসা মেটানোর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ঘরে বাইরে সমালোচনার (BJP States) মুখে পড়ে ২০১৯ সালে পকসো আইন সংশোধন বিল পাশ হয় সংসদের দুই কক্ষ রাজ্যসভা ও লোকসভায়। সংশোধনীতে হিংস্র যৌন নির্যাতনের মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়। অর্থাৎ বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড। শিশু নির্যাতনের ঘটনার গুরুত্ব বোঝাতে সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা ছিল ‘নির্ভয়া ফান্ডের’ আওতায় দেশে এক হাজার তেইশটি ‘ফার্স্ট’ ট্র্যাক’ তৈরি করা হবে। স্কুলের শিক্ষাক্রমে ‘গুড ট্যাচ, ব্যাড ট্যাচ’ সম্পর্কে শিশুদের অবহিত করতে পাঠ্যক্রম তৈরি করা হবে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সময় বেঁধে তদন্ত, আবেদনের দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তি, জামিনের কড়াকড়ি, নতুন ফার্স্ট ট্র্যাক আদালত, বিশেষ বিচার সহায়ক গবেষণাগার তৈরির ন্যায় নীতির কথাও সেসময়ে বলা হয়। কিন্তু আইনের এই কঠোর প্রয়োগের বিধান থাকা সত্ত্বেও বাস্তব চেহারাটা বড়ই করুণ। শুধু ২০২১ সালেই উত্তরপ্রদেশে ৭ হাজার ১২৯টি, মহারাষ্ট্রে ৬ হাজার ২০০টি এবং মধ্যপ্রদেশে ৬ হাজার ৭০টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। অথচ সাজাপ্রাপ্তির হার উত্তরপ্রদেশে ৬৪.২ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২৬.১ শতাংশ এবং মধ্যপ্রদেশে ৩৩.৫ শতাংশ। শুধু এই তিন রাজ্যই নয়, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ছ’বছরে পকসো আইনে মামলার সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বাড়লেও সাজাপ্রাপ্তির হার গড়ে ৪০ শতাংশের নিচে থেকেছে। আসলে আইন কঠোর করেও যে বিশেষ লাভ হয়নি বা প্রশাসনিকস্তরে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে— তার প্রমাণ এই বেড়ে চলা পরিসংখ্যান।
এই ধরনের অপরাধে লাগাম টানাতে পারছে না। অথচ রাজনৈতিক স্বার্থে গেরুয়া বাহিনী মডেল রাজ্য হিসাবে ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের সাফল্যের ঢাক পেটাতেই সদাব্যস্ত!
কিন্তু আসল সত্যিটা হচ্ছে, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাচ্ছে না। কিছুতেই যাচ্ছে না।