ক্রোড়পতি দুর্বৃত্তদের দল ওরা

সম্পদশালী প্রার্থীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা। ধনী প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা যত বেশি হয় সেই অনুপাতে নির্বাচনে ধনের অন্তঃপ্রবাহ তত বৃদ্ধি পায়। এক জটিল বৃত্তে আটকে পড়ে গরিবের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। মুখোশ ছিঁড়ে মুখ চেনালেন অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

ভারতীয় জনতা পার্টি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের যে ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, সেটিতে রয়েছে ৭৮টি ছবি, যার ৫৩টিতেই রয়েছে নরেন্দ্র মোদির ছবি, কোথাও একা কোথাও অগ্রভাগে। এই ৭৬ পাতার ইস্তাহারে মোট ৬২টি বার ‘মোদি’ শব্দটি লেখা হয়েছে আর ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ ২৫ বার লেখা হয়েছে। আসলে মোদি ইকুয়াল টু দেশ নামক যে প্রবণতা ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরি করেছে সেই প্রবণতাকে তারা আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে। এই স্রোতের আড়াল দিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি আরেকটি যে চোরাস্রোতকে বইয়ে দিচ্ছে তা হল বিপুল সম্পদশালী ও অপরাধের অভিযোগসম্পন্ন প্রার্থীদের নির্বাচনের টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়া। পেশিশক্তি (মাসল পাওয়ার), অর্থশক্তি (মানি পাওয়ার) ও ভুল তথ্য (মিস ইনফরমেশন, এই তিন ‘এম’কে হাতিয়ার করে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সলতে পাকিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (Shame On BJP)।

ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ নামক সংস্থার রিপোর্ট থেকে পশ্চিমবাংলার ৪২টি কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসাব বিশদে জানা যায়। দেখা যাচ্ছে ৪২টি কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৭৪২ কোটি ৭৭ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৪২ টাকা, অর্থাৎ ৪২ জন প্রার্থীর এক-এক জনের গড় সম্পত্তির পরিমাণ হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ১৭ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা। পশ্চিমবাংলার ভারতীয় জনতা পার্টির কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যাটাও বেশ তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো, ২৮ জন। মোট ৪২ জন প্রার্থীর ৬৬ শতাংশের অধিক কোটি টাকার উপর সম্পত্তির মালিক। ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ নামক সংস্থা সারা ভারতবর্ষের ৫৪৩টি কেন্দ্রের ৮৩৩৭ জন প্রার্থীর নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া সম্পত্তির যে হিসাব, সেটিকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে মোট ২৫৭২ জন প্রার্থী অর্থাৎ ৩১ শতাংশ কোটি টাকার উপর সম্পত্তির মালিক, ৩১ শতাংশের তুলনায় পশ্চিমবাংলার ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীদের ৬৬ শতাংশের হিসাবটা অনেকটাই অধিক। প্রশ্নটা এখানেই যে, যে ভারতবর্ষ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১১তম স্থান অধিকার করে সেখানে পশ্চিমবাংলার এই বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীরা কি আমার-আপনার প্রকৃত প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য?

আরও পড়ুন- ধর্মগ্রন্থ নিয়ে নোংরামি, তাড়াব বিজেপিকে

বিপত্তির আরেকটি ভয়ংকর সংকেত হল সম্পদশালী প্রার্থীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে অপরাধের অভিযোগসম্পন্ন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীর সংখ্যা। ৪২টি কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীদের মোট অপরাধের সংখ্যা ৩১৩টি, অর্থাৎ এক একজন প্রার্থীর গড় হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭টির অধিক। এক বা একের অধিক অপরাধের অভিযোগ আছে এইরকম প্রার্থীর সংখ্যা ২৯ জন অর্থাৎ ৪২ জন প্রার্থীর শতাংশের হিসাবে ৬৯ শতাংশের অধিক। সারা ভারতবর্ষের ৮৩৩৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ২০ শতাংশ অপরাধে অভিযুক্ত এবং ১৪ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অপরাধে অভিযুক্ত, সেই নিরিখে ৬৯ শতাংশের ছবিটা পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে একটি আতঙ্কের বার্তা বহন করে। সম্পদশালী ও দুর্বৃত্তদের মিশেলে নানা আশঙ্কা দানা বাঁধে। প্রথমত, ধনী প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা যত বেশি হয় সেই অনুপাতে নির্বাচনে ধনের অন্তর প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, দেশের জনসংখ্যার বৃহদংশ জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকে এক ধরনের বিনিয়োগ হিসাবে দেখা হয় পরিণামে প্রার্থীরা তাঁদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বেশি উত্তরদায়ী হয়ে যান। ভারতীয় জনতা পার্টি চাইছে ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ণের পরিবর্তে সম্পদশালীদের ক্ষমতায়নে এনে সাধারণ মানুষের পরিসরকে সংকুচিত করে দিতে।

বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১০৮তম, লিঙ্গবৈষম্যের এই প্রকট গ্লানিকে চাপা দিতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতীয় জনতা পার্টি তড়িঘড়ি করে মহিলা সংরক্ষণ বিল, ২০২৩ পাশ করিয়ে নেয় এবং তা আইনে পর্যবসিত হয়। যদিও এই আইনের কার্যকারিতা ২০২৭ সাল থেকে শুরু হবে। মহিলা সংরক্ষণের এই আইন লিঙ্গবৈষম্যের যে ক্ষত তা মেরামতের এক মেকি প্রচেষ্টা, নীতিগত জায়গা থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দল কীভাবে লিঙ্গবৈষম্যকে গুরুত্ব দিতে চায় তা পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি কেন্দ্রে তাদের প্রার্থীদের পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার হওয়া যায়। এই মহিলার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী লোকসভা, রাজ্য বিধানসভা ও দিল্লি বিধানসভার মোট আসনের ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, সেই হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের ৩৩ শতাংশ আসন অর্থাৎ ১৩.৮৬(১৪)টি কেন্দ্রে বিজেপির মহিলা প্রার্থী দাঁড় করানোর নীতিগত দায়িত্ব বর্তায়, সেই নীতিগত দায়বদ্ধতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৪২টি কেন্দ্রের জন্য ভারতীয় জনতা পার্টির মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭। মহিলা সংরক্ষণ আইনের অপর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য যত সংখ্যক আসন সংরক্ষিত তার তিন ভাগের একভাগ তপসিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করতে হবে। এই রাজ্যে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে তফসিলি জাতির জন্য ১০টি ও তফসিলি উপজাতির জন্য ২টি আসন সংরক্ষিত। আইনের হিসাব অনুযায়ী ১০টি কেন্দ্রের তিন ভাগের একভাগ অর্থাৎ ৩.৩৩(৩)টি কেন্দ্রের আসন তফসিলি জাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে, ভারতীয় জনতা পার্টি (Shame On BJP) নীতিগতভাবে এই জায়গাটিকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্রে ১ জন মাত্র তফসিলি জাতির মহিলাকে প্রার্থী করেছে এবং তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ২টি আসনে তাদের মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা শূন্য। ৪ জুনের ভোটের ফলাফলের অনেক আগেই ভারতীয় জনতা পার্টি (Shame On BJP) যে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সংকটকে পরিষ্কার করে দিয়েছে তা বলার অপেক্ষায় রাখে না।

Latest article