কয়েকদিন আগে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গ্রামাঞ্চলে গিয়েছিলাম। হুগলি-বর্ধমানের সীমান্ত অঞ্চল। চাষবাসে উন্নত। উর্বর জমি। ১৫ বছর আগের চেয়ে ওই সব অঞ্চল পরিকাঠামোর দিক থেকে এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট, সেচ ব্যবস্থা— সবেতেই উন্নতির চিহ্ন স্পষ্ট।
কয়েকদিন ছিলামও সেখানে। বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছি, মানুষজনের সঙ্গে কথাও বলেছি। একসময় এই সব অঞ্চলে সিপিএমের হার্মাদরা ছিল বিভীষিকা। পার্টির কথাই শেষ কথা। তাদের বিচারই শেষ বিচার। আজ সেই পরিবেশ আর নেই। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের পর থেকে জোড়াফুলের পতাকা সর্বত্র পত পত করে উড়ছে।
আরও পড়ুন-আপেল-কমলালেবুর মিশেলে নয়া জাতের কুল চাষে চমক
কান পাতলেই গ্রামবাসীর মুখে শোনা যাবে, তিন টার্মের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ভূয়সী প্রশংসা। জন্ম থেকে মৃত্যু, সব পরিবারের সব সদস্যের দায়িত্ব সরকারের। আরও কত প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা সরাসরি পাচ্ছে, দলমত নির্বিশেষে সবাই। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের ভাঁওতাবাজির সঙ্গে মা-মাটি-মানুষের সরকারের কাজে পার্থক্য সাধারণ মানুষই বলে দিচ্ছে। আগের জমানার সঙ্গে এই আমলের মৌলিক তফাত হল, দুয়ারে সরকার। আক্ষরিক অর্থেই, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে শাসক দলের দাদা-দিদি ধরতে হয় না। তাদের কাছেই সরাসরি পৌঁছে যায় সরকারি প্রকল্পের সুবিধা। আগে কখনও গ্রামের মানুষ এসব ভাবতেই পারত না। নির্দ্বিধায় সেকথা কবুল করে তারা বলে, ‘মমতাদি আমাদের কাছে আল্লা-ঈশ্বর!’
আরও পড়ুন-ফুটপাথবাসীদের জন্য শহরে আরও নাইট শেল্টার
হ্যাঁ, গ্রামের এইসব মানুষদের আবার তীব্র ক্রোধ দেখেছি, কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে। ২ বছর হয়ে গিয়েছে, তারা ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা হাতে পায়নি। আবাস প্রকল্পে ঘর বানানো থেকে শুরু করে, অর্থের অভাবে শেষ করতে পারেনি অনেকেই। অনেকে তো ছাদের বদলে ত্রিপল খাটিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ ফুঁসছে। তারা পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন্দ্রের এই ভাতে মারার চক্রান্তের জবাব দিয়েছে। লোকসভার নির্বাচনেও রাজ্যের প্রতি অবিচারের বিহিত চাইতে চায় গ্রামবাসী।
সঠিকভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। লাগাতার আন্দোলনও শুরু করে দিয়েছে। কয়েকমাস আগে খোদ রাজধানীর বুকে কয়েক হাজার বঞ্চিত মানুষকে নিয়ে মিছিল করে দিল্লি কাঁপিয়ে এসেছেন যুব তৃণমূল কংগ্রেসের কান্ডারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের সাফ কথা, ১০০ দিনের কাজ, আবাস প্রকল্পের ২ বছরের বকেয়া টাকা কেন্দ্রকে দিতে হবে। টাকার পরিমাণ কত? কেন্দ্রের কাছে ১০০ দিনের কাজের মজুরি বাবদ বকেয়া ৩৭৩২ কোটি টাকা। মজুরি ছাড়া উৎপাদন বাবদ বকেয়া আরও ৩১৮১ কোটি টাকা। মোট বকেয়া টাকার পরিমাণ ৬৯১৩ কোটি টাকা। কোনও একটা প্রকল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটি প্রাপ্য টাকা পায়নি। দেশে এমন কোনও রাজ্য আছে? না, নেই। প্রতিহিংসার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে?
আরও পড়ুন-আজ রাজ্য বাজেট পেশ
কেন টাকা বন্ধ? কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, রাজ্য সরকার ১০০ দিনের কাজের খরচের টাকার হিসাব দেয়নি। ক্যাগ রিপোর্টেও নাকি এমন অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের লিখিত রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সরকার সঠিক সময়ে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের খরচের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছে। খোদ এই প্রকল্পের ডিরেক্টর হিসাবের প্রাপ্তিস্বীকার করেছেন।
একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক রীতিমতো ডিরেক্টরের চিঠির জেরক্স ছেপে দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তিন তিনটি চিঠি গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসারকে পাঠিয়েছেন মনরেগা প্রকল্পের ডিরেক্টর ধরমবীর ঝা। ১০০ দিনের কাজের কিস্তি সংক্রান্ত এইসব চিঠি। প্রথম চিঠি যায় ২২ জুন, ২০২১ সালে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় চিঠি যায় ১৪ ডিসেম্বর। তিনটি চিঠিতে ডিরেক্টর ঝা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের তরফে কোনও ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার কাজ পড়ে নেই।’ একইভাবে আবাস প্রকল্প নিয়েও ২০২২ সালের ২৪ মার্চ একইরকম চিঠি জমা পড়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে।
আরও পড়ুন-কালাকানুন মানব না, ধরনায় শপথ শ্রমিকদের, ধরনায় আজ সংখ্যালঘু সেল
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর গেরুয়াবাহিনী ১০০ দিনের কাজ এবং আবাস প্রকল্প নিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছেন তা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজেপি রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে মোকাবিলা করতে অক্ষম। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে রামমন্দিরের হাওয়া নেই। তাহলে কী করা যাবে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কুৎসা প্রচারই বিজেপির হাতিয়ার। মমতা এবং জোড়াফুল মানুষের পাশে ছিল, আছেও। তাই কেন্দ্রের ভরসায় না থেকে ১০০ দিনের কাজে ২১ লক্ষ বঞ্চিত মানুষকে বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি এবার যাবে কোথায়? লোকসভার নির্বাচন বুঝিয়ে দেবে, বাংলার মাটি, মমতার দুর্জয় ঘাঁটি!