হিন্দুদের পবিত্রভূমিতে মসজিদ থাকবে না। থাকতে পারে না। ১৯৯২ সালে কট্টরপন্থী যে প্রচারের জন্ম লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতীরা দিয়েছিলেন, তারই ষোলোকলা পূর্ণ হতে চলেছে। জ্ঞানবাপী মসজিদের ভবিষ্যৎ কী? সম্ভলের উত্তাপ বাড়ছে কেন? এবার কি টার্গেট আজমির শরিফ? এই প্রশ্নগুলো কি সাধারণের মনে আসছে না? বুঝতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটু বেশিই ভারী হয়ে উঠছে হাওয়াটা? রোজগার মেলা, জাতীয় সড়ক, নতুন বিমানবন্দর… সবই পিছনের সারিতে। একটি শব্দেরই অনুরণন এখন নতুন ভারতে… ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম। আচমকাই অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ পরিবার। বিজেপির নিচু থেকে শীর্ষস্তর— সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছে তাদের নির্দেশ। হিন্দুত্বের বার্তা। তারা জানিয়ে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় ইনিংসে হিন্দুত্ব ছাড়া আর কোনও অ্যাজেন্ডা নেই। থাকতে পারে না। তাহলে অচিরেই ক্ষমতার অলিন্দ থেকে হারিয়ে যাবে গেরুয়া শিবির। এই নির্দেশ কেন? সমাজের নিচুতলায় কাজ করে ওরা। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন তাদের। আমজনতার মন পড়েই তারা বুঝেছে যে, উন্নয়ন প্রশ্নে আর ভোটারদের মগজধোলাই করা যাবে না। একটা টার্ম মানুষ আচ্ছে দিনের আশা করেছে। পরের পাঁচ বছরে চূড়ান্ত অপেক্ষা। কিন্তু তৃতীয় ইনিংসে পৌঁছে আর আশা থাকবে না, অপেক্ষাও না। তাই হিন্দুত্ব, এক এবং অদ্বিতীয় অ্যাজেন্ডা।
আরও পড়ুন-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বেড়েছে কেন্দ্রের বরাদ্দ! ৫ রাজ্যে বাঘের মৃত্যুর গ্রাফও ঊর্ধ্বমুখী
গেরুয়া কট্টরপন্থী রাজনীতি নিজ গুণে বাড়তে পারছে না। পারবে না। তাহলে উপায় কী? অন্য ধর্মকে দুরমুশ করে সেই জায়গা দখল করা। তারই নবতম সংযোজন আজমির শরিফ।
ভারতে বিদেশি মুসলিম শাসকদের হামলা আগেও হয়েছে। কিন্তু মহম্মদ ঘোরির অভিযানের সময়কাল ছিল তাঁদের সবার থেকে আলাদা। কারণ, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পরই এই দেশে নজরে পড়ার মতো ইসলামের বিস্তার। সেটাও খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির হাত ধরে। তিনি এসেছিলেন এ দেশে। থেকেও গিয়েছিলেন। রাজস্থানের আনা সাগরের পাড়ে একটি গাছতলা ছিল তাঁর প্রথম আস্তানা।
ঠিক যে জায়গায় এসে প্রথম তিনি বসেছিলেন, সেখানেই হয়েছে পরবর্তীকালে আজমির শরিফ দরগা। সবচেয়ে বড় কথা, এই দরগা কিন্তু শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জন্য এখানে অবারিত দ্বার। বহু হিন্দু আছেন, বড় কোনও কাজে নামার আগে আজমির দরগায় চাদর চড়িয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চড়িয়েছেন। গত লোকসভা ভোটের আগেই। উরস উৎসবের সময়। তাহলে হঠাৎ তাঁর দলই কেন এই আজমিরের ‘উৎস’ নিয়ে তড়পানি শুরু করল? কারণ, ভোট হয়ে গিয়েছে। এখন পাঁচ বছর নিশ্চিন্ত। এর মাঝে যদি মেরুকরণের বাজার গুছিয়ে নেওয়া যায়, ক্ষতি কী? আর সাম্প্রদায়িকতার ‘যুদ্ধে’ আজমির শরিফের থেকে বড় অস্ত্র ভূ-ভারতে নেই। তাই রাজস্থান হিন্দু সেনার পক্ষ থেকে আদালতে পিটিশন ফাইল হল, আজমির শরিফের জায়গায় নাকি আগে মহাদেবের মন্দির ছিল! তাই এর একটা বিহিত চাই। কেমন হবে সেই বিহিত? আদালত কি ওখানেও সার্ভের রায় দেবে? এএসআই পরীক্ষা করে দেখবে, আজমির শরিফ সত্যিই শিবমন্দিরের উপর তৈরি কি না? রামলালার পর মহাদেব মন্দিরের রাজনীতি শুরু হয়ে যাবে? বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার কিন্তু ভুলে যাচ্ছে, আজমির শরিফ কিন্তু বাবরি সৌধ নয়। ১৯৯২ সালে ভারতবর্ষ মন্দির রাজনীতি নিয়ে সংঘর্ষের ট্রেলার দেখেছিল। আজমির শরিফ নিয়ে নাড়াচাড়া পড়লে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাবে।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে অসভ্যতা চলছে: আইনজীবীদের মেরে হুমকি দিয়ে চিন্ময়ের শুনানি আটকে দিল
একটা কথা সবাইকে বুঝতে হবে। সনাতন ধর্মের ভিত এতটাই মজবুত যে, তাকে নাড়ানো যায় না। তার বিস্তৃতি অপার। হিন্দুত্বের রক্ষক বলে যারা নিজেদের দাবি করছে, তারা আসলে সূর্যের দিকে টর্চের আলো ফেলছে। আর পুরোদমে চলছে রাজনীতি। প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। কারণ পাবলিক বোকা নয়। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, দেশে তাহলে ‘প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট’ থাকার মানেটা কী? সংবিধান এবং আইন বলেছে, এই দেশে কোনও ধর্মের উপর আঘাত হানা যাবে না। ধর্ম পালন প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশের সর্বত্র প্রত্যেক ধর্মস্থানের পরিচয় যা ছিল, ভবিষ্যতেও তা থাকবে। তারপরও বাবরি ‘মেগা শো’ হয়েছে, জ্ঞানবাপী সিরিজ চলছে, মথুরার শাহি ইদগার পর সম্ভলের কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। ধর্মের নামে মোহ ঘিরে ধরছে রাজনীতিকে। তার আঁচে সাধারণ মানুষ মরছে, মারছেও। এই ভারত কিন্তু আমরা চাইনি।
গণতন্ত্রহীন অবস্থায় ভুগতে ভুগতে, সামরিক বুটের তলায় থাকতে থাকতে এমন এক দুঃস্বপ্নলোকে বা ডিস্টোপিয়ান স্টেটে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। দ্বিজাতি তত্ত্বের জাতক রাষ্ট্র পাকিস্তান। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রণোদনা তার সৃষ্টির পেছনে ছিল, কিন্তু সংখ্যালঘু স্বার্থ নির্বাহের সাংবিধানিক দায় তার কস্মিনকালেও ছিল না, আজও নেই। হিন্দু নিকেশের কাজ সেদেশে নিষ্পন্ন করে সেদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীসমূহ পরস্পরের দিকে বন্দুক তাক করছে এখন। শিয়া-সুন্নির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এই সেদিনকেও কুরম জেলা দেখেছে। সুন্নিদের পাশাপাশি আহমেদিয়ারাও সেদেশে নিগৃহীতদের তালিকায়।
পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতকে এক পঙ্ক্তিতে রাখা যায় না। একদা ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে একযোগে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশ ভাষাসত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আজ ফের দুদেশে ধর্মীয় পরিচয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আর সেই আবহে মোদির ভারতও তার ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান ঝেড়ে ফেলে হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যদি আমরা তাতে মদত দিই, তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলছে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সর্বাত্মক আধিপত্যবাদের জন্ম দেয় আর তার অনিবার্য পরিণতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কচুকাটা হয়।
আমরা কি হিন্দু রাষ্ট্রের নামে সেটাই চাই?