দিনে দিনে বেড়ে চলেছে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ রক্তের ক্যানসারে বা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৭ লক্ষের জীবনহানি ঘটে। প্রতি ২৭ সেকেন্ডে অন্তত একজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর ভারতে প্রতিবছর ৭০ হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। সেপ্টেম্বর হল ব্লাড ক্যানসার-সচেতনতা মাস। যত দ্রুত উপসর্গ ধরতে পারবেন তত দ্রুত চিকিৎসা এবং ততটাই প্রাণের ঝুঁকি কমবে। তাই এই ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি।
এই রোগে আক্রান্ত হলে রক্তের মধ্যে থাকা উপাদানগুলির অনিয়ন্ত্রিত গঠন এবং বিস্তার হতে থাকে। রক্তের ক্যানসারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি হল অ্যাকিউট বা তীব্র এবং অন্যটি হল ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী। তিন ধরনের ক্যানসার রয়েছে মূলত। লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং মাল্টিপল মায়লোমা।
আরও পড়ুন-নেপালের ব্ল্যাক-ডে, বলছেন অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা
লিউকেমিয়া
এই ক্যানসার মূলত রক্ত এবং অস্থিমজ্জায় হয়। এর কারণ রক্তে শ্বেতরক্ত কণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এর ফলে অস্থিমজ্জা লোহিত রক্ত কণিকা এবং প্লেটলেট তৈরি করার ক্ষমতাকে হ্রাস করে।
লিম্ফোমা
লিম্ফোমা হল যখন রক্তের ক্যানসারের অকুস্থল হয় লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম বা লিম্ফোসাইট কোষ। এই লিম্ফোসাইট হল এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা যা শরীরের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
মাল্টিপল মায়লোমা
রক্তের ক্যানসারের সবচেয়ে বিপজ্জনক রূপ হল এই মাল্টিপল মায়লোমা। খুব দ্রুত ক্যানসার কোষ বিভাজিত হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মায়লোমা ধরা পড়লে তার নিরাময় খুব কঠিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি থাকে। রক্তে প্লাজ়মা কোষ যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলে তখন এই রোগ দেখা দেয়। এর ফলে শরীরের একাধিক অঙ্গ প্রভাবিত হয়। তাই মাল্টিপল কথাটা জোড়া হয়েছে। এর মধ্যেই পড়ে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়াও যা একটি বিরল ধরনের অ্যানিমিয়া। এই রোগে অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা হয়।
উপসর্গ
দীর্ঘদিনের জ্বর আসা, বারবার জ্বর আসা, ঠান্ডা লাগা।
রক্তাল্পতার জন্য দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, বুক ধড়ফড়।
পায়ে জল জমা, ত্বকের রং ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
খিদে কমে যাওয়া এবং ওজন কমতে থাকা, বমি-বমি ভাব।
রাতের দিকে খুব ঘাম হওয়া।
হাড় এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
পেটের মধ্যে অস্বস্তি, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া। লিভার ও প্লীহার আকার বেড়ে যাওয়া।
মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট।
ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া।
ত্বকে চুলকানি বা ত্বকে ফুসকুড়ি।
ঘাড়, বগলের নিচে বা কুঁচকিতে ফোলা লিম্ফ নোড।
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ ব্লাড ক্যানসারের অন্যতম উপসর্গ। কোনও কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ শুরু হলে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুন-বাড়িতে আগুন লাগাল বিদ্রোহীরা, ঝলসে মারা গেলেন প্রাক্তন মন্ত্রীর স্ত্রী
কেন হয় এই ক্যানসার
সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াই ব্লাড ক্যানসার হতে পারে। তবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল, কীটনাশক বা পেস্টিসাইড, ভেজাল খাবার, হেয়ার ডাই, লুব্রিকেন্টস, বার্নিশ, কেমোথেরাপি ড্রাগস ও কিছু জেনেটিক অসুখও দায়ী এই ক্যানসারের ক্ষেত্রে। এছাড়া ধূমপানের বদ-অভ্যেস। আগে পরিবারে কারও ক্যানসার থাকলে সেই পরিবারে আবার তা হবার সম্ভাবনা থাকে অর্থাৎ জেনেটিকও। উচ্চমাত্রার কোনও বিকিরণের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থাকা। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ শক্তি। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা লুপাসে রোগের ইতিহাস থাকলে হতে পারে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা। যেকোনও কারণে অস্থিমজ্জার ভেতরের রক্তের স্টেম সেলের মিউটেশন বা অন্য কোনও পরিবর্তন হলে ক্যানসার সেল বা অপরিপক্ব কোষ তৈরি হয়, যা অস্থিমজ্জার ভেতরে অতি-দ্রুত বৃদ্ধি হয় ও রক্তে প্রবাহিত হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
লিম্ফোমার ক্ষেত্রে গ্ল্যান্ড বা টিস্যুর বায়োপসি। এছাড়া ইমেজিং স্ক্যান বা সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পেট স্ক্যান, এক্স-রে, আলট্রাসোনোগ্রাফি। এর সঙ্গে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট টেস্ট বা সিবিসি টেস্ট। বোনম্যারো টেস্ট ইত্যাদি।
চিকিৎসা
স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন, শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত বা অসুস্থ কোষকে সুস্থ স্টেম সেল দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতিতে নতুন, সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি হয় এবং শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামত করা হয়।
কেমোথেরাপি
এই পদ্ধতিতে শরীরে ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি বন্ধ করতে ক্যানসার-বিরোধী ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি
এটি ‘পার্সোনালাইজড মেডিসিন’ নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতিতে শুধু ক্যানসার কোষকেই টার্গেট করে চিকিৎসা করা হয় ফলে রেডিয়োথেরাপি বা কেমোথেরাপিতে যেমন ক্যানসার কোষ নষ্ট করতে গিয়ে তার চারপাশে থাকা সুস্থ কোষগুলিও নষ্ট হয়ে যায় টার্গেটেড থেরাপিতে সেটা হয় না।
ইমিউনোথেরাপি
ইমিউনোথেরাপি হল ক্যানসার চিকিৎসার এমন একটি পদ্ধতি যা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপিত ও উন্নত করে। এটি ক্যানসার কোষ শনাক্তকরণ এবং ধ্বংস করতে সহায়তা করে, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
রেডিয়োথেরাপি
ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে বা ব্যথা বা অস্বস্তি দূর করতে রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের আগেও দেওয়া যেতে পারে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রোগ নিরাময়ের জন্য অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনও করা হয়ে থাকে।
এই রোগে সুস্থতার সম্ভাবনা
ব্লাড ক্যানসার মানেই মারণব্যাধি নয়। ঠিক সময় রোগ নির্ণয় হলে অনেক ব্লাড ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে অ্যাকিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক, যার দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হয়। টার্গেটেড থেরাপি আবিষ্কৃত হওয়ায় ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি ঘটেছে। এই থেরাপিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৮৫% সুস্থতার সম্ভাবনা থাকে।