শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়: ২১ জুলাই ১৯৯৩-এর কথা লিখতে বসলে মনটা আমার ৩১ বছর পরেও বিষাদময় হয়ে ওঠে। মরিচঝাঁপির মতো ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস পশ্চিমবাংলায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম ক্ষমতায় এসেই এই বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় যা আমি নিজের চোখে দেখিনি, কয়েক শত উদ্বাস্তু প্রাণ হারায় ও কয়েক শত মানুষ আহত হয়, সমস্ত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাও চরম অত্যাচার করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ভারতের মানুষ আজও ভুলতে পারিনি। কমিউনিস্টদের বর্বরতার ইতিহাস আরও ভয়ংকর।
আরও পড়ুন-অমর ২১ জুলাই, বীর শহিদরা অমর রহে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দীর্ঘ আন্দোলনের পথ ধরে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। ছাত্র অবস্থা থেকে লড়াইয়ের পথেই হেঁটেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে যেখানে মানুষের উপর অত্যাচার হয়েছে সেখানেই ছুটে গিয়েছেন তিনি। এই সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট সিপিএমের নেতৃত্বে বিপুলভাবে ক্ষমতায় আসে ১৯৭৭ সালে। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত সব নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং, সন্ত্রাস, ছাপ্পা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। বাংলার অত্যাচারিত কর্মীরা, দিল্লির কংগ্রেস নেতাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর দিল্লির কাছে করুণা ভিক্ষা নয়, লড়াই করেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। একের পর এক নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যেভাবে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন ‘NO IDENTITY CARD NO VOTE’. অর্থাৎ প্রকৃত ভোটার ভোট দিক। ভূতুড়ে ভোটারদের ভোট করে জিততে দেব না। তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি চালু করা, নতুন শিল্প স্থাপন, বেকার সমস্যার সমাধান ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের দাবি। সিদ্ধান্ত নিলেন মহাকরণ অবরোধের ডাক দেবেন, যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে সিদ্ধান্ত নিলেন যুব কংগ্রেসের ডাকেই এই অবরোধ কর্মসূচি হবে। সমস্ত যুব নেতাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে জেলায় জেলায় কর্মিসভা ও জনসভা করার নির্দেশ দিলেন। প্রথমে ২১শের আগেই সভার দিন স্থির হলেও তৎকালীন রাজ্যপাল মারা যাওয়ার জন্য স্থির হয় ২১ জুলাই ’৯৩ রাইটার্স বিল্ডিংটি মাঝখানে রেখে পাঁচ জায়গায় অবরোধ হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পেলেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রশাসন এই অবরোধ বানচাল করে দেওয়ার জন্য কোনও ত্রুটি রাখেনি এবং ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সমস্ত চক্রান্ত জানার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন যে আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে সভা হবে। যাদের রক্তে হিংস্রতা, যাদের নীতিতে বিরোধী মানেই শ্রেণিশত্রু, তাদের কাছে অহিংস আন্দোলনের বার্তায় কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি যেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ২১ জুলাই।
২১ জুলাই সত্য বাপুলি, পঙ্কজ ব্যানার্জি, আমি, মদন মিত্র মেয়ো রোডের মোড়ে দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমি মেয়ো রোডের মোড়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক এবং চরম স্বৈরাচারী শাসকের অত্যাচারের কথা তুলে ধরতে চাই।
আরও পড়ুন-আমরা তো ভুলি নাই শহিদ…
আমরা সকলেই সকাল সকাল মেয়ো রোডের মোড়ে গিয়ে ম্যাটাডরে উঠলাম এবং একের পর বক্তব্য রাখা শুরু করলাম কারণ আমরা যখন পৌঁছলাম তখন দেখি ম্যাটাডরের সামনে অনেক কর্মী এসে জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। সামনে একটা দড়ি দিয়ে আড়াল করে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ। ততক্ষণে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, দক্ষিণ কলকাতা, বেহালা থেকে একের পর বিশাল মিছিল আসছে এবং সামনের দিকে এগোচ্ছে। দেখতে দেখতে মেয়ো রোডের মোড়ের জমায়েত বিশাল আকার নিয়েছে। ধর্মতলা, ব্রেবোর্ন রোড, বউবাজার-সহ সর্বত্র জনপ্লাবনে পরিণত হয়েছে। পিছনের দিকে চাপ সহ্য করতে না পেরে ছেলেরা সামনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, এটাই ছিল শাসকদের চক্রান্ত, ওরা জানত বলেই সব জায়গায় মঞ্চ বাঁধতে দিলেও মেয়ো রোডের মোড়ে মঞ্চ বাঁধতে দেয়নি।
জনতার চাপে ছেলেরা যখন দড়ি ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায় তখন পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। পঙ্কজ ম্যাটাডর থেকে চলে যায় পুলিশের সামনে এবং পুলিশ কেন লাঠি নিয়ে তাড়া করল সেই নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হয়ে যায়। পঙ্কজ বলতে চাইল পিছনের চাপে ওরা এগিয়ে গেছে। হঠাৎ পুলিশ আবার লাঠিচার্জ করে এবং পঙ্কজের মাথায় লাগে ও রক্ত পড়তে থাকে। আমরা পঙ্কজকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই এবং সভা চালাতে থাকি। প্রায় ৯টা ৩০ মিনিট নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন একটি স্কুটারে চেপে। তিনি সবক’টি জমায়েতেই যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তব্য শুরু করলে বিশাল জমায়েত নিস্তব্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনে। তিনি বলেন সকলকে শান্ত থেকে সভা চালাতে হবে। পুলিশকেও অনুরোধ করেন অকারণে উত্তেজনা না করতে।
আরও পড়ুন-২১ জুলাই, ১৯৯৩…
এদিকে ক্রমাগত মিছিল আসতে থাকে আর সামনের দিকে চাপ বাড়তে থাকে। মমতা যাওয়ার সময় আমাকে বলে যান, শেষ পর্যন্ত থাকবেন। আমরা বক্তৃতা চালাতে থাকি। সেদিন ছিল আকাশ পরিষ্কার আর প্রচণ্ড রোদের তাপ। কিছুক্ষণ পরে মদনের শরীর খারাপ লাগার জন্য আমাদের বলে চলে যায়।
সত্যদা, আমি আর জেলার কিছু নেতা সভা চালাতে থাকি। আবার পিছনের দিকে চাপ বাড়তেই কিছু ছেলে পুলিশের দড়ি ঠেলে ঢুকে যায় আর সেটাই ছিল কসাই মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের পাতা ফাঁদ। একদল পুলিশ টিয়ার গ্যাস চার্জ করতে করতে আর একদল লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে। আমরা পুলিশকে অনুরোধ করলেও শোনে না। আমাদের ছেলেরা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে মাঠের দিকে আর কিছু কর্মী ডানদিকে প্রেস ক্লাবের দিকে চলে যায়। আমরা আবার সভা শুরু করি এবং পুলিশকে বারবার অনুরোধ করি সংযত হওয়ার জন্য। এবার ছেলেরা আবার জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। তখন এক বীভৎস দৃশ্য দেখে শিউরে উঠি, একদল পুলিশ বন্দুক হাতে এগিয়ে আসছে। এই সময় পুলিশ আবার লাঠিচার্জ করে। ফলে কিছু ছেলে সামনের দিকে এগোতে থাকে, কিছু ছেলে মাঠের দিকে চলে যায়। এই সময় সত্যদাও শরীর খারাপ লাগছে বলে চলে যায়। তখন আমি একা মাইকে পুলিশকে অনুরোধ করছি। এবার লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস চার্জ ও গুলি চালাতে শুরু করে। কিছুটা দূরে গুলি লাগে এবং মাটিতে পড়ে ছটফট করতে শুরু করে ও জল জল বলে চিৎকার করতে থাকে। পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে আসতে থাকে আর আমাদের ছেলেরা মাটিতে পড়ে যেতে থাকে। রক্তাক্ত হয়ে যায় মেয়ো রোডের কালো পিচের রাস্তা। মরিচঝাঁপি, বিজন সেতু, ছোট আঙারিয়া, সুচপুর, কান্দুয়া, ঘোকসাডাঙা, ধানতলা, বানতলা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই-সহ অসংখ্য নিষ্ঠুর বর্বরতার সাক্ষী এই পশ্চিমবাংলা। পশ্চিমবাংলাকে দেশের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে উন্নত রাজ্য বলেই স্বীকার করে দেশ। এই অত্যাচার বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভূলুন্ঠিত করেছে।
আরও পড়ুন-২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল উপভোগ করার, কিন্তু আত্মতুষ্টি নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
মেয়ো রোডের মোড়ে যখন পুলিশ বেপরোয়া গুলি ও টিয়ার গ্যাস চালাচ্ছে তখন আমি দেখি বাঁদিকে মাঠে পুলিশের সঙ্গে আমাদের ছেলেদের ঠেলাঠেলি চলছে। একটি ছেলেকে পুলিশ গুলি মেরে নর্দমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের ছেলেরা তাকে বার করছে। ওরা ছেলেটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলে আমি গাড়িটা একটু প্রেস ক্লাবের দিকে নিয়ে যাই। আমি ক্রমাগত পুলিশকে সংযুত হতে বলতে থাকি। গুলি না ছোঁড়ার অনুরোধ করতে থাকি। হঠাৎই একটা টিয়ার গ্যাসের শেল আমার গায়ে লাগে। ধোঁয়া মুখে ঢুকে যায়, চোখ জ্বলতে থাকে, বমি শুরু হয়। গাড়ির কাছেই সুপ্রিয়া, শ্রীমন্ত, গোপালরা গাড়ি থেকে টেনে নামায় ও পাঁজাকোলা করে প্রেস ক্লাবের টেবল টেনিস বোর্ডের উপর শুয়ে দেয়। মুখে জলের ছিটে দিতে থাকে। বমি বন্ধ হলে ওরা গাড়ি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে নিয়ে যেতে বলে, বাড়িতে ঘর অন্ধকার করে শুইয়ে দিলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে উঠে কাগজে পড়ে দেখি ১৩ জন কর্মী খুন হয়ে গিয়েছে। ২০৬ জন গুরুতর আহত হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অজ্ঞান অবস্থায় প্রথমে হাসপাতালে ও পরে নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত হয়েছেন। আমি নার্সিংহোমে গেলে জানতে পারি আঘাত গুরুতর, সময় লাগবে। দীর্ঘদিন মমতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই ভয়ঙ্কর, অমানবিক, বর্বর ও স্বৈরাচারী আক্রমণ ছিল পূর্ব পরিকল্পিত অর্থাৎ মানুষ খুনে কমিউনিস্টদের হাত একটুও কাঁপেনি।
২০১১ সালে পশ্চিমবাংলার মানুষ মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নারকীয় বর্বরতার অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন রাজ্যের গরিব, নিম্নবিত্ত-সহ সাধারণ মানুষের জন্য নানা প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের হাতে অর্থ জোগান দিতে হবে। গত ১২ বছরে রাজ্যকে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেছেন।
আরও পড়ুন-২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল উপভোগ করার, কিন্তু আত্মতুষ্টি নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
বিজেপি, সিপিএম লাগাতার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে, মমতা পঞ্চায়েত, পুরসভা দখলের সাথে সাথে ২০১৬ ও ২০২১ সালে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করে বাংলার মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে অব্যাহত রেখেছেন। ২০২৪ সালে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে লোকসভা নির্বাচনে ২৯টি আসন দখল করে সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং দেশের মানুষ তাঁকে নেত্রী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।