বডি শেমিং অপরাধ

হাসি, মশকরা, মজার ছলে কারও চেহারা নিয়ে তির্যক মন্তব্য আমূল বদলে দিতে পারে উল্টোদিকের মানুষটির জীবন। গভীর অবসাদ, ইটিং ডিজর্ডার থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা— হতে পারে সবকিছুই। আলোচনা করলেন বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক প্রথমা চৌধুরী এবং সমাজতাত্ত্বিক অনিরুদ্ধ চৌধুরী। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ঘটনা এক : ছোট্ট থেকে একটু গোলগাল রায়া। কোনওদিন ওর ওজন কমতে দেখেনি কেউ। তখন এই গোলগাল চেহারার জন্যই রায়া সবার কাছে আলাদা অ্যাটেনশন পেত। কেউ কখনও গাল দুটো টিপে দিত, কেউ একটু চটকে নিত, কেউ-বা কোলে তুলে নিত। পরবর্তী কালে রায়ার এই গোল মোটাসোটা চেহারাটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। যেখানেই যায় ওই চেহারা নিয়ে কুমন্তব্য শুনতে হয় ওকে। কী করবে সে! আদাজল খেয়ে তাকে রোগা হতেই হবে বলে লেগে পড়ে। খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়। একটা সময় এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসক বলেন অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার শিকার রায়া। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা জরুরি।

আরও পড়ুন-শীতের বেড়ানোর প্রস্তুতি

ঘটনা দুই : শৌনক বরাবর একটু অন্য ধরনের। ও স্বাভাবিক হলেও গলার স্বর, কথা বলার ধরন একটু নারীসুলভ। ছোট থেকেই যে বন্ধুদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে তারাই ইদানীং ওকে ছক্কা, লেডিজ বলে হ্যাটা করে। সেদিন বাড়িতে ফিরে চুপ করে বসেছিল শৌনক। রাতে কিছু খায়নি। শৌনকের মা ঝুমা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কী হয়েছে? কিন্তু ও কোনও কথাই বলেনি। এই ভাবে প্রত্যেকদিন ওকে বুলি করত বন্ধুরা। ক্লাসের মেয়েরাও একটা সময় ওই নামে ডাকতে শুরু করে। শিক্ষকদের কাছে নালিশ জানিয়েও বিষয়টা গুরুত্ব পায়নি। একদিন রাতে সুইসাইডের চেষ্টা করে শৌনক। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় পরিবারের তৎপরতায়। এরপর অনেক জলঘোলা হয় বিষয়টা নিয়ে। শেষে স্কুল বদল করে শৌনক।

ঘটনা তিন : কণিকা কমবয়সে ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। বিয়ে হয়ে যখন এই পাড়ায় এসেছিলেন তখন সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত মুগ্ধ হয়ে। এখন বয়স পঞ্চাশের কোটায়। পায়ের সমস্যায় হাঁটাচলা করতে বেশ কষ্ট হয়, ওজনটাও এই ক’বছরে বেড়ে গেছে অনেকটা। ইদানীং রাস্তায় বেরলে তাঁকে দেখে চমকে ওঠে সবাই। চেনাজানা মানুষ সামনে পড়লেই জিজ্ঞেস করে, এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার! এ কী চেহারা। পায়ে কী হল! সেদিন বাবার এক বন্ধুর স্ত্রী কণিকাকে দেখে বললেন, তুই তো একদম পাল্টে গেছিস রে। কী সুন্দরী না ছিলি! একটু তো খেয়াল রাখবি নিজের। কণিকা লজ্জায় বিরক্তিতে কোথায় মুখ লুকোবেন বুঝে পান না। এরকম মন্তব্য থেকে বাঁচতে কণিকা এখন বাড়ি থেকে বেরনো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন।
মহিলা হন বা পুরুষ— কমবেশি অনেককেই জীবনে হয়তো এই ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। হাসি, মশকরা, মজার ছলে কারও চেহারা নিয়ে তির্যক মন্তব্য, কটাক্ষ— একধরনের মানসিক বিকৃতি। এই বিকৃতির নামই হল বডিশেমিং। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে শব্দটা খুব ভাইরালও। সেলেব থেকে সাধারণ— বডি শেমিংয়ের শিকার সবাই।
এই তালিকায় প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, কৃতি শ্যানন, দীপিকা পাড়ুকোন, ভারতী সিং, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়— কে নেই! এই বিষয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া একবার নিজেই তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন, ‘‍‘তখন আমি অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি পাইনি। মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জিতেছি। এক প্রযোজকের সঙ্গে কাজ নিয়েই কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমার শরীরে নাকি কিছু ঠিক নেই। কোনও কিছুর শেপই ভাল নয়। এমনকী নাকটাও খুব খারাপ!’’

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

নেটিজেনদের কু-মন্তব্যের শিকার হয়েছেন কৃতি শ্যাননও। ‘মুবারকা’ ছবিতে কৃতির ‘হাওয়া হাওয়া’ গানের সঙ্গে নাচ ভিডিও আপলোড করার সঙ্গে তাঁর নাচকে ব্যঙ্গ করেন দুই নামজাদা অভিনেতা-অভিনেত্রী। এক ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জন্য একবার ফটোশ্যুট করেন দীপিকা পাড়ুকোন। আর সেই ছবি স্যোশাল সাইটে আপলোড করার পরই সেই ছবিতে আসতে থাকে নানা ধরনের কুৎসিত মন্তব্য। তিনি অপুষ্টিতে ভুগছেন বলে কেউ কেউ কটাক্ষ করেন, আবার কেউ ভাল করে খাবার খেতে বলেন। অভিনেত্রী দিশা পাটানি তাঁর জীবনের প্রথম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের দিন তিনি একটি ব্ল্যাক গাউন পরেছিলেন, সেই গাউনের লো নেক-লাইনের কারণে দিশার বক্ষ-বিভাজিকা প্রদর্শিত হয়। সেই নিয়ে শুরু হয়েছিল কুমন্তব্য করা।
এই ঘটনা নিয়ে সরবও হয়েছিলেন দিশা। কমেডি কুইন ভারতী সিং তাঁর এনগেজমেন্টের একটি ছবি পোস্ট করার পর সেখানে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘ইয়ে হুয়া আসলি কম্বিনেশন হাতি অর চিটি কা (একেই বলে একটা পিঁপড়ের সঙ্গে একটি হাতির কম্বিনেশন)। বিয়েতে মানুষ শুভেচ্ছা পাঠায় কিন্তু ভারতী বিয়ের পর পেয়েছেন অসংখ্য খারাপ কমেন্ট। যেটা তাঁর জীবনের তিক্ততম অভিজ্ঞতা। কেট মিডলটন ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য হয়েও তির্যক মন্তব্য এড়াতে পারেননি। বডি শেমিং নিয়ে ভুক্তভোগীর তালিকাটা অনেক বড়। সেলেবদের বেবি বাম্প নিয়ে ছবি তোলার ট্রেন্ড আসার পর থেকে এই বডি শেমিং আরও তীব্রভাবে বেড়েছে। টলিউডের অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় সন্তান জন্মের আগে-পরে একটানা চেহারা নিয়ে বহু তির্যক মন্তব্য শুনে গেছেন। তিনি প্রতিবাদ করেছেন, উত্তর দিয়েছেন কিন্তু ফলাফল কিছু হয়নি!
সম্প্রতি চেহারা নিয়েই ট্রোলড হলেন নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রীও। কদর্য ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হল। তাঁকে বলা হল এত ভারী চেহারা নিয়ে কী করে অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে! বলিউড, টলিউডে সম্ভবত এমন কেউ নেই, যিনি কটাক্ষের শিকার হননি। কারও চেহারা তো কারও গায়ের রং— এই কটাক্ষের কারণ। নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় এই ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু এতে কতটা কী সমাধান হবে বলা খুব মুশকিল।
অজান্তেই বিদ্রুপ করি আমরা
জেনে বা না-জেনে আমরা অনেকেই কিন্তু ‘বডি শেমিং’ করি। সুন্দর চেহারা দেখে চট করে মুগ্ধ হওয়া, বেশির ভাগ মানুষেরই চরিত্র। আবার সে-রকম চটকদার বা ঝকঝকে চেহারার না হলে, আমরা অনেকেই তাঁকে পাত্তা দিই না। যাঁরা ফর্সা-কালো, বেঁটে-লম্বা, রোগা-মোটার উপর নির্ভর করে মোহগ্রস্ত হন, তাঁদের সেই প্রবণতাকে ‘বডি শেমিং’ ই বলে। সোশ্যাল মিডিয়াতে হ্যাশ ট্যাগ স্টপ বডি শেমিং জাতীয় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বহুবার কিন্তু ফল শূন্য।
পরিবারেই রয়েছে এর বীজ
বডি শেমিং শুধু অন্যায় নয় অপরাধও। এর কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে উল্টোদিকের মানুষটার জীবন এমনকী সম্পূর্ণ নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
ক্রমাগত কারও শারীরিক ত্রুটি নিয়ে বিদ্রুপ একটা সময় মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। গভীর অবসাদে চলে যেতে পারেন সেই ব্যক্তি। আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। তখন মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বডি শেমিং থেকে হতে পারে বিভিন্ন রোগও। খুব ছোটবেলা থেকেই পরিবারেই বডি শেমিংয়ের মতো অভিজ্ঞতা হয় ছেলে-মেয়েদের। বাড়িতে এবং পরবর্তীতে স্কুলে-কর্মক্ষেত্রে এটা চলতেই থাকে। আত্মীয়দের মধ্যেই অনেককে বলতে শোনা যায় মার মতো সুন্দর দেখতে হয়নি বা বাবার মতো ফরসা হয়নি— এটাও বডি শেমিংই। জন্মদাত্রী বাবা-মা সন্তানের গায়ের রং কালো হলে আজও দুশ্চিন্তা করেন। একই বাড়ির দুই বোন বা দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের চেহারা নিয়ে হয়তো প্রশংসা করা হচ্ছে অপরজনকে কিছুই বলা হচ্ছে না এটাও পরোক্ষভাবে বডি শেমিংই।
বডি শেমিংয়ের প্রভাব
হয়তো আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই অনেককেই বডি শেমিং করে ফেলি। এর থেকে তৈরি হয় বেশ কিছু মানসিক রোগ। কাউকে বারবার মোটা বলা হচ্ছে। এমনটা শুনতে-শুনতে সেই ছেলেটি বা মেয়েটি হঠাৎ মারাত্মকভাবে নিজের ওজন কমাতে শুরু করল তখন সেটা অ্যানরেক্সিয়া নার্ভোসায় পর্যবসিত হতে পারে— অর্থাৎ এমন ওজন কমাল সে যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হল। নচেৎ বাঁচতই না হয়তো। আবার কেউ ফরসা হবে বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কেমিক্যাল ব্লিচ করতে শুরু করল এবং ত্বকের চামড়ার ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে ফেলল। আবার কেউ শরীরের কোনও একটা অঙ্গের খুঁত নিয়ে ভীষণ সচেতন হয়ে উঠল। একে বলা হয় বডি ডিসমরফিয়া। এগুলো যে কোনও কারণেই হতে পারে যার মধ্যে অন্যতম কারণটি হল বডি শেমিং। এখান থেকে গভীর অবসাদ আসতে পারে, আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ ভেঙে যাতে পারে এমনকী মানুষটারই বদল ঘটে যেতে পারে।

আরও পড়ুন-এসএসসি নবম-দশমের ফল প্রকাশিত, নিয়োগে সময় বাড়াতে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি

সোশ্যাল মিডিয়া
আগে যদিও বডি শেমিং বিষয়টা পরিবারের মধ্যে বা স্কুল, কলেজের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকত কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই ধরনের সমস্যা এখন অনেক সময়ই গুরুতর আকার নেয়। ‘সবাই জেনে ফেলল’— এই মনোভাব ব্যক্তিকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে, ইটিং ডিজর্ডার হতে পারে। তখন মনোবিদের কাছে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বেশ কিছু থেরাপি রয়েছে যা হয়তো তাঁকে এই মানসিক অবস্থা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়। যেমন ‘কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি’। এটা একধরনের টক থেরাপি। এর মাধ্যমে নেতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে সেগুলোকে আরও বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক চিন্তায় পরিবর্তন করার কৌশল শেখানো হয়। হয়তো সত্যি কারও চেহারায় খুঁত রয়েছে, যেমন অ্যাসিড ভিক্টিম, যে তাঁর ক্ষেত্রে যদি বডি শেমিংয়ের মতো সমস্যা আসে তখন ‘অ্যাকসেপটেনস অ্যান্ড কমিটমেন্ট থেরাপি’ খুব কাজ দেয়। কষ্টকর চিন্তা ও অনুভূতি এড়িয়ে না গিয়ে সেগুলোকে মেনে নেওয়া এবং নিজের মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবন গড়তে নিজের কাছেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া শেখানো হয় এই থেরাপিতে। গভীর অবসাদ এলে সেখানেও থেরাপি কাজে দেয়। তবে সবকিছু থেরাপির মাধ্যমে কমে না। যেমন অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার ক্ষেত্রে রোগীকে ভর্তি করে তার পুষ্টি ব্যালেন্স করে ওষুধ দিতে হবে।
বডি শেমিং নিয়ে যুদ্ধ নয়
বডি শেমিং থেকে গোটা পৃথিবীকে রোখা সম্ভব নয়। তাই জরুরি হল নিজের এবং পরিবারের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। একটা শিশুকে ছোট থেকে এমনভাবেই বড় করা যে চেহারাটা কোনও বিষয় নয়। তার মধ্যেও এই ভাবনা গড়ে তোলা ‘কে আমার চেহারা নিয়ে কী বলল তাতে কিছু এসে যায় না’। মনে রাখতে হবে চেহারাটাই কারও পরিচয় হতে পারে না। অনেক বাবা-মা-ই ছোট থেকে নিজের শিশুটিকে সাজিয়ে, গুছিয়ে রাখেন। সেই সব শিশুই সাজগোজ ও সৌন্দর্য-সচেতন হয়ে পড়ে ছোট থেকেই এবং পরবর্তীতে এদের বেশিরভাগের মনে হয় চেহারাটাই বুঝি সব। আমি কি এই প্রশ্নটার মধ্যে যেন চেহারা না থাকে বা থাকলেও তা যেন গৌণ হয়। বাবা-মা যেন সবসময় ছেলেমেয়েদের একাধিক দিক নিয়ে বড় করে তোলেন।

আরও পড়ুন-মুখরক্ষায় বরখাস্ত চার অপারেশনস ইনস্পেক্টর

জরুরি সমসচেতনতা
বডি শেমিং এক সামাজিক সমস্যাও। এটি সরাসরি কোনও আইনি অপরাধ বলে বিবেচিত নয়। এর জন্য কোনও জেল-জরিমানাও হয় না কিন্তু এটা সাইবারবুলিং বা হয়রানির আওতায় পড়লে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে। তবে বডি শেমিং নৈতিকভাবে ভুল এবং ক্ষতিকারক আচরণ। আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরেই এটা ছিল। দিনে দিনে তার রূপবদল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা পশ্চিমি ভাবধারায় গা ভাসিয়েছি, যেখানে চেহারাটাই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুঠোফোনে বন্দি জীবনে জিরো ফিগার হল ট্রেন্ডিং। গ্লোবালই এখন সবাই চেহারা সম্পর্কে প্রচণ্ড পরিমাণে সচেতন। চেহারা নিয়ে চলছে অনমনীয় প্রতিযোগিতা। সিনেমার হিরো মানে পারফেক্ট বডি। হিরোইন মানে নিখুঁত। পান থেকে চুন খসলে ট্রোলিংয়ের বন্যা। সুন্দর স্লিম চেহারাই আইডিয়াল— এটার পিছনেও রয়েছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও। প্রসাধনী সামগ্রীর বাজারদর, রমরমা, ফর্সা হবার ক্রিমের বিজ্ঞাপন— সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বডি শেমিংয়ের শিকড়। তাই খেলার মাঠ থেকে সিনেমার পর্দা— ট্রোলিং সর্বত্র। স্যাডিস্ট মানসিকতার মানুষজন নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন করে এইভাবে। আবার নেগেটিভ কমেন্টসকেও কেউ কেউ নিজের প্রচারের কাজে লাগায়। এর মূল কারণ ফিজিকাল সমাজ ছোট হচ্ছে আর ভার্চুয়াল সমাজ বড় হচ্ছে। সেখানে আমরা সবাইকে বন্ধু বলছি অথচ কেউ কাউকে চিনি না! ঘাপটি মেরে থাকা সেইসব মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা ট্রোলাররা কদর্যতার মাত্রা ছাড়ায়। তাদের চিনে নেওয়া বা চট করে খুঁজে পাওয়া মুশকিল ফলে সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। বডি শেমিংয়ের প্রভাব মানুষকে আড়ালে থাকতে বাধ্য করছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে। সেই পুরনো পাড়া কালচার, মুখোমুখি আড্ডা, গল্প— সম্পর্কগুলো দেখা যায় না বলেই একজন ষাটোর্ধ্ব মহিলা হাঁটুর বয়সির কাছে ট্রোলড হন! আমাদের মধ্যে থেকে সামাজিকতা হারিয়ে যাচ্ছে বলেই বাসে, ট্রামে, ট্রেনে নব্বই শতাংশ মানুষ স্ক্রিনে চোখ দিয়ে বসে থাকে। এর জন্য ভার্চুয়াল আস্তানা থেকে বেরনো জরুরি। আর জরুরি কালেকটিভ কনশাসনেস। কোনও প্রতিষ্ঠানে বডি শেমিংয়ের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবারে বডি শেমিং হতে পারে, এমন কোনও আচরণ উৎসাহিত করা যাবে না। শিক্ষকরা নিজেরা যেন কখনও কোনও শিক্ষার্থীকে বডি শেমিং করে না ফেলেন, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

Latest article