বইপাড়ার নববর্ষ-উৎসব

পয়লা বৈশাখ। বইপাড়া সেজে ওঠে নতুন সাজে। প্রায় সমস্ত প্রকাশকের ঘরেই হয় হালখাতার পুজো। লেখকদের আপ্যায়িত করা হয়। অতীতের ধারা বজায় রেখে প্রকাশিত হয় নতুন বই। জমে ওঠে আড্ডা। বহু উৎকৃষ্ট সাহিত্যের বীজ বপন হয় মননশীল আসর থেকেই। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

নরম ভোরে আনন্দের গুঁড়ো
পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বছরের বাকি দিনগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নরম ভোরে লেগে থাকে আনন্দের গুঁড়ো। সেই গুঁড়ো অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ে শরীরে, মনে। সঙ্গে থাকে সারাদিন। তীব্র দাবদাহে তাই কষ্ট উধাও। সন্ধেবেলার মৃদু হাওয়ার শিরশিরানি রবীন্দ্রনাথের গানের মতো। আনন্দকে পৌঁছে দেয় চরমে। পয়লা বৈশাখ মানেই তো বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা। নতুন পোশাক, খাওয়াদাওয়া, কাছেপিঠে ঘুরতে যাওয়া। আর? গান শোনা, দু-চার পাতা বই।
বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা
বই বলতেই মনে আসে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার কথা। নববর্ষে বইপাড়া সেজে ওঠে নতুন সাজে। প্রায় সমস্ত প্রকাশকের ঘরেই হয় হালখাতার পুজো। তাঁদের আমন্ত্রণে আসেন লেখক, প্রচ্ছদ-অলংকরণ শিল্পীরা। অতিথিদের জন্য থাকে বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা। ডাবের জল, সরবত, মিষ্টি, নোনতা, চা ইত্যাদি। সঙ্গে নতুন ক্যালেন্ডার। একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রবীণ লেখকের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেন নবীন লেখকরা। সারাদিন চলে জমজমাট সাহিত্য-আড্ডা। সিরিয়াস আলোচনার পাশাপাশি অনেকেই মেতে ওঠেন রঙ্গরসিকতায়। বহু উৎকৃষ্ট সাহিত্যের বীজ বপন হয়েছে এইসব মননশীল আসর থেকেই। কোনও কোনও প্রকাশক নববর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ করেন নতুন বই। কিছু কিছু লেখকের প্রাপ্তিযোগও ঘটে। প্রকাশকের তরফে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বকেয়া অর্থ। ভিড় জমান পাঠকরাও। বই কেনেন। নেন প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ। এখন অবশ্য নিজস্বীর যুগ। সারাদিন গমগম করে বইপাড়ার অলিগলি। সর্বত্র ধরা পড়ে উৎসবের মেজাজ। ছড়িয়ে থাকে অদ্ভুত ভাললাগা।

আরও পড়ুন-রাজ্যপালের স্বাক্ষর ছাড়াই তামিলনাড়ুতে ১০ আইন পাশ, দেশের ইতিহাসে প্রথম এই পদক্ষেপ

ইতিহাস বহু পুরনো
বইপাড়ায় নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস বহু পুরনো। কেমন ছিল অতীতের উৎসবের রং? স্মৃতিচারণ করলেন মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায়। বইপাড়ার ভানুবাবু। তিনি জানিয়েছেন, আগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি জায়গায় আড্ডা বসত। সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। আসতেন ছাপাখানা, বাঁধাই ঘরের লোকজন। বেলার দিকে আসতেন দিকপাল লেখকরা। মিত্র ও ঘোষের নববর্ষের আড্ডা বসত গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষকে ঘিরে। সারাদিন চলত আড্ডা। আগের জৌলুস কিছুটা ফিকে হলেও আড্ডার ধারাটা আজও বজায় রয়েছে। এখন আসেন নতুন প্রজন্মের লেখকরা।
দেখা যেত নক্ষত্র সমাবেশ
দে’জ পাবলিশিং হাউস-এ সাতের দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়েছে নববর্ষের আড্ডা। কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে জানালেন, একটা সময় আমাদের ঘরে দেখা যেত নক্ষত্র সমাবেশ। আসতেন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকরা। এখন আসেন এই সময়ের লেখকরা। প্রতি বছর লেখকদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় একটি খাতা। তাঁরা নানারকম মন্তব্য লেখেন। চলে খাওয়াদাওয়া। এই বছরও পয়লা বৈশাখের দিন আমাদের কয়েকটি বই প্রকাশিত হবে।
মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা
২০০৯ সাল থেকে পত্রভারতী বইবিপণিতে বসছে জমজমাট পয়লা বৈশাখের আড্ডা। কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন, আমাদের নববর্ষের আড্ডায় এসেছেন বহু প্রবীণ খ্যাতনামা লেখক। এখন আসেন এই সময়ের বিশিষ্ট লেখকেরা। মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা থাকে। পাশাপাশি থাকে ঘরে তৈরি ডিমের ডেভিল। প্রতি বছর নববর্ষে আমরা কিছু বই প্রকাশ করি। এবারেও বেরবে নতুন বই। সারা বছর অপেক্ষায় থাকি বিশেষ দিনটির জন্য।
বেরবে নতুন বই
কথা হল দীপ প্রকাশনের কর্ণধার দীপ্তাংশু মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, পয়লা বৈশাখের দিন আমাদের কফিহাউসের বিপণিতে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। লেখকরা আসেন। পাঠকরা আসেন। থাকে মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। এখন বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হয় কলকাতা বইমেলায়। তবে আমরা প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ কিছু নতুন বই প্রকাশ করে থাকি। এবারেও বেরোবে কিছু নতুন বই।
জমজমাট আড্ডা
কীভাবে কাটান পয়লা বৈশাখের দিনটি? সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানালেন, একটা সময় নিয়মিত পয়লা বৈশাখের দিন কলেজ স্ট্রিট যেতাম। আনন্দ পাবলিশার্স-এ বসত সাহিত্য-আড্ডা। আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। গল্পগুজব হত। আড্ডার আসর বসত মিত্র ও ঘোষের দফতরেও। গত কয়েক বছর অবশ্য নানা কারণে পয়লা বৈশাখের দিন বইপাড়ায় যেতে পারি না। ওইদিন বাইরে থাকি। এখন কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হয়। আগে কিন্তু পয়লা বৈশাখেই নতুন বই প্রকাশিত হত। কোনও কোনও প্রকাশক অবশ্য এখনও পয়লা বৈশাখের দিন বই প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন-ওয়াকফ নিয়ে বিভেদের বিষ ছড়াচ্ছে বিজেপি

আতিথেয়তা দেখে অভিভূত
সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত বললেন, পয়লা বৈশাখ বই পাড়ায় প্রকাশকরা লেখকদের যে আপ্যায়ন করেন, যখন বই লিখতাম না, তখন ধারণার বাইরে ছিল। বড় লেখক, মেজ লেখক, ছোট লেখক ভেদাভেদ চোখে পড়ে না। আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকেই সমানভাবে যত্ন করা হয়। এই ঘটনাটা আমরা খুব একটা লিখি না। বলিও না। বাংলা ভাষার লেখকরাও যে এইরকম আত্মীয়তা, ভালবাসা, সম্মান পাওয়ার যোগ্য, সেটা নববর্ষ প্রমাণ করে। আমরা সাধারণত বলি পাঠক শ্রেষ্ঠ, পাঠক ঈশ্বর। কিন্তু মনে রাখি না, প্রকাশক না থাকলে পাঠকের কাছে আমরা পৌঁছতেই পারতাম না। প্রথম যখন আমি পয়লা বৈশাখ বই পাড়ায় আসি, আতিথেয়তা দেখে অভিভূত হয়ে যাই। এত যত্নের অধিকারী আমরা! এত ভালবাসা, এত আপ্যায়নের অধিকারী! অথচ বাইরে শুনতে পাই বাংলা বই নাকি বিক্রি হয় না। প্রকাশক কতটুকুই বা পয়সা পায়। দেখে অবশ্য অন্যরকম মনে হয়। সম্পূর্ণ একটা আলাদা বিষয় হয়ে যায়। বাংলা ভাষার লেখকের প্রতি প্রকাশকের আতিথেয়তা, যত্ন নিয়েই একটা লেখা হতে পারে। পয়লা বৈশাখ বই পাড়ায় প্রকাশকদের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি বাংলা ভাষা কেন আমাদের গর্বের ভাষা, প্রাণের ভাষা।
অসুস্থ শরীরে এসেছিলেন
সাহিত্যিক জয়ন্ত দে জানালেন, আমি তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে পয়লা বৈশাখের দিন বইপাড়ায় যাচ্ছি। একটা সময় আসতেন আমাদের অগ্রজ লেখকরা। মনে পড়ছে, একবার অসুস্থ শরীরে এসেছিলেন দিব্যেন্দু পালিত। দে’জ-এর সামনে গাড়িতেই বসেছিলেন। প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গে গিয়ে আমরা দেখা করে এসেছিলাম। করুণা প্রকাশনী এবং মিত্র ও ঘোষের ঘরে দারুণ আড্ডা হত। রথী-মহারথীরা আসতেন। গল্প করতেন। তখন আমরা নতুন। কোণে চুপ করে বসে সব শুনতাম। ত­খন প্রবীণ লেখকরা নবীন লেখকদের নিয়ে যেতেন প্রকাশকদের পয়লা বৈশাখের আড্ডায়। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমিও বহু নবীন লেখককে নিয়ে গেছি। জমজমাট আড্ডা হয়, খাওয়াদাওয়া হয়। দারুণ কাটে বছরের প্রথম দিনটা।
চায়ের কাপে তুফান
কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় বললেন, পয়লা বৈশাখে বইপাড়া আগেও আনন্দধারা বইত, এখনও সেই ধারা বইছে। বদলে গিয়েছে মুখ, নাম, বদলে গিয়েছে কিছু কিছু বইয়ের দোকান। কিন্তু নববর্ষের আনন্দ বইপাড়া থেকে হারিয়ে যায়নি। কলকাতায় অন্য অনেক রাস্তার মতো কলেজ স্ট্রিট সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলায়নি। আসলে এখানে তো পড়াশোনা হয়। এখানে তো তাঁরাই বেশি ঘোরেন, যাঁরা পড়তে ভালবাসেন। এই পাড়ার প্রাণ তো বই৷ বই তো এমনিতেই চিরনূতন৷ একেকটি বই একেকটি নতুন আবিষ্কার। তাই বইপাড়ার আর বাইরের চাকচিক্য বদলানোর দরকার হয়নি৷ যখন আমি প্রথম প্রথম কবিতা লিখছি তখন সাহিত্য জগত এককথায় চোখ ধাঁধানো গ্যালাক্সি! তখনও বেঁচে রয়েছেন দিকপাল লেখকরা। এঁদের চলনবলন আদায় করে নিত সমীহ। কথা বললে বোঝা যেত যে, যাঁর সঙ্গে কথা বলছি তিনি একজন জাত লেখক। তাঁরা কেউ-ই খুব অ্যাকাডেমিক কথা বলতেন না যদিও৷ কিন্তু তাঁদের সাধারণ কথাও জাত চিনিয়ে দিত৷ এখনও সাহিত্য জগৎ শুকিয়ে যায়নি বলেই আমার ব্যক্তিগত মত। বড় বড় লেখক, তারকা যাঁরা, তাঁদের এখন পয়লা বৈশাখে বইপাড়ায় কম দেখা যায়৷ তবে নবীন লেখক কবিদের চায়ের কাপে তুফান ওঠে। অনেক বিখ্যাত প্রবীনও থাকেন। কিন্তু আগের থেকে প্রবীন লেখকদের যাতায়াত কমেছে বইপাড়ায়৷

আরও পড়ুন-বাংলা নববর্ষের মুখে চারদিনের টানা ছুটিতে বাড়তি ভিড় দিঘায়

বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ
যতদিন বাঙালি থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে বইপাড়া। ঘুরেফিরে আসবে পয়লা বৈশাখ। হালখাতাকে কেন্দ্র করে ফি-বছর বইপাড়া মেতে উঠবে নববর্ষ-উৎসবে। এই উৎসব মিশে গেছে বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গে। কোনওদিন ছেদ পড়বে না।

Latest article