মোটামুটি দুর্গাপুজো শেষ হলেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ফি বছর। নতুন বই প্রকাশের ঝক্কি অনেক। ডিটিপি, প্রুফ রিডিং, বাইণ্ডিং, প্রচ্ছদ, প্রখ্যাত লেখকদের সময় নেওয়া সব মিলিয়ে একটা রাজকীয় যজ্ঞ শুরু হয়ে যায় কলকাতার প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অন্দরে৷ নামী-দামি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বছর দুয়েক আগে শুরু হওয়া লিটল ম্যাগাজিন, বই আর এই প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোর প্রস্তুতিটা চলে সারাবছর ধরেই। কিন্তু বইমেলার আগে সেই প্রস্তুতির গতি বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ভাবলে অবাক লাগে, আজ গোটা দেশ জুড়ে যেভাবে মূর্খের আস্ফালন চলছে, যেভাবে শিক্ষাকে বোতলবন্দি করে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে ফিরিয়ে আনতে বধ্যপরিকর হয়েছে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। যেখানে‘পুরাণকে ইতিহাস আর ইতিহাসকে পুরনো’ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে প্রতিদিন।
আরও পড়ুন-হাওড়া যুব তৃণমূল কংগ্রেসের বিশেষ উদ্যোগ, পরীক্ষার্থীদের পাশে ‘অভিষেকের দূত’
বইপড়া বা একটু পড়াশোনা করা মানুষজনদের খুব সহজে ‘শহুরে নকশাল’ বা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে দাগিয়ে দেওয়াটা এই মুহূর্তে দিল্লির সরকারের কাছে সবচাইতে সহজতম কাজ। কখনও জেলে ভরা হচ্ছে কখনও-বা প্রকাশ্যে বা সামাজিক মাধ্যমে ‘লিঞ্চ’ করা হচ্ছে। যেন পড়াশোনা করাটাই মস্ত বড় অপরাধ! তার চেয়ে বিজেপি আইটি সেল দ্বারা প্রেরিত হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ভুয়ো তথ্য বা ইউটিউবের ‘রিলস’ দেখে নেওয়াটাই অনেক কার্যকরী। গোটা দেশ যখন এই হাওয়ায় গা ভাসিয়েছে, তখন স্রেফ বইকে ভালবেসে, বইয়ের উদযাপনে মেতে উঠছে বাংলা। হ্যাঁ, এখানেই ব্যতিক্রমী যায় আমার রাজ্যটা৷ গোটা বাংলা থেকে বইপ্রেমী রসিক পাঠক এসে হাজির হচ্ছেন সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে। শিয়ালদহ থেকে সেন্ট্রাল পার্ক মেট্রোয় তিলধারণের জায়গা নেই। সেই ভিড়ে যেমন আছে মা-বাবা’র সাথে আসা প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়া, তেমনিই আছেন সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণও। নিন্দুকেরা খানিক মুখ বেঁকিয়ে বলতেই পারেন, বইমেলায় লোকে এখন ছবি তুলতে যায়! বামপন্থী আঁতেলরা চৌত্রিশ বছরের চোঁয়া ঢেকুর তুলে আজকাল প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে লেখেন এখনকার বইমেলায় নাকি বইয়ের চেয়ে খাবারের স্টল বেশি। ফেসবুকের দৌলতে এখন নাকি সবাই লেখক। সবাই সেলফি তুলছে.. ইত্যাদি…ইত্যাদি…।
আরও পড়ুন-বাদাম চাষে লাভের মুখ দেখছেন হুগলির চাষিরা
এরকম নানান অভিযোগ এককালের আগুনখেকো বামপন্থীরা করে থাকেন। সেই সব আগুনখেকোদের সবিনয়ে বলতে ইচ্ছে করে, শুধু গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ এর বইমেলাতে পা রেখেছেন প্রায় ২৫ লাখ মানুষ! আর গিল্ডের হিসেব অনুযায়ী গতবছর মোট বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকার! হ্যাঁ, এই কিন্ডল, ম্যাকবুক, ই-বুক, পিডিএফের যুগেও র্যাক ঘেঁটে নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে ২৭ কোটি টাকার বই কিনেছে এই রাজ্যের বইপ্রেমীরা! শুধু রাজ্য নয় গোটা দেশে বোধহয় এরকম দ্বিতীয় কোনও রাজ্য নেই, যেখানে এত মানুষ স্রেফ বইয়ের জন্য এক হয়, বই কেনে। বা স্রেফ দেখে। নতুন বইয়ের পাতা উলটে নেয়। নতুন বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে সেই বইয়ের মুখবন্ধ পড়ে নেওয়াতেও আলাদা সুখ আছে। সপ্তাহের কাজের দিনেও জমজমাট বইমেলা প্রাঙ্গণ। দূরের জেলাগুলো থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ভিড় জমাচ্ছেন মেলার মাঠে। ২০১১ থেকে বইমেলায় ঢুকতে আর কোনও প্রবেশমূল্য লাগে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসা ইস্তক অন্য সব উৎসবের মতো বইমেলাকেও করে দিয়েছেন ‘সর্বজনীন’। বইমেলাও হয়ে উঠেছে সকলের মিলনস্থল। শহরের নামী প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বাইরের লম্বা লাইন ভিড়ের টক্করে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে নবমীর সুরুচি সংঘ বা চেতলা অগ্রণীকে। শুধু ভারতবর্ষ কেন, পৃথিবীর আর একটিও এমন শহর আছে কি না সন্দেহ যেখানে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বই কেনে! ভারতের অনান্য রাজ্যে যখন দেখি উন্মত্ত জনতা বিগ্রহ দর্শনে গিয়ে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ডেকে আনে তখন আমাদের রাজ্যের রাজধানীতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। তারপর ধীর লয়ে স্টলে ঢুকে কিনে নেন পছন্দের বইটা। সেটা কখনও, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ‘অ্যান আরগুমেন্টেড ইন্ডিয়ান’ কখনও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণের শেষ ক-টা দিন’। স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা আজও বাবা-মায়ের কাছে বায়না করে ফেলুদা সমগ্রর জন্য! টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক এখনও অভিযানের যাওয়ার জন্য ডেকে চলেছে। ফেলুদা-টিনটিন মিতিন মাসিদের আবেদন যেন চিরকালীন। চেতন ভগত বা আমিশ ত্রিপাঠীর বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বই!
আরও পড়ুন-কুচকাওয়াজ থেকে ট্যাবলো, পুরোভাগে নারীবাহিনীর চমক ছাঁটাই সুইগিতে, কাজ হারাবেন ৪০০ কর্মী
কোনও প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে উপহার দেয়, শ্রীজাত বা জয় গোসাঁইয়ের কবিতার বই। সদ্য সাহিত্য আকাডেমি পাওয়া স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘জলের ওপর পানি’ হটকেকের মতো উড়ে যাচ্ছে স্টল থেকে! লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে উঠতি লেখক লেখিকাদের ভিড়। ২৬-২৭ বছরের স্মার্ট ঝকঝকে তরুণ কবি সম্পাদক। ফেসবুকে লেখালেখির সাথে বাৎসরিক প্রিন্টেড সংখ্যা নিয়ে হাজির নতুন প্রজন্মের সম্পাদক। সঙ্গে তাঁর বয়সিই একঝাঁক নতুন কবি সাহিত্যিক। যাদের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে বেশ পরিচিত।তার মধ্যেই বছর বছর পঁয়ষট্টির এক পরিচিত সম্পাদকের দেখা মেলে। যিনি উত্তর ২৪ পরগনার এক মফস্বল শহরে ৩০ বছর ধরে একটা ছোট পত্রিকা চালাচ্ছেন। তাঁর পত্রিকার এখনো কোনো অনলাইন সংখ্যা বেড়োয়না। এখনও শ্বাশত কাগজের হার্ডকপিই ছাপিয়ে যাচ্ছেন। বছরে এখনও চারটে সংখ্যা বেড়োয়। সেসব সংখ্যা নিয়েই হাজির প্রবীণ সম্পাদক। পাশাপাশি দুই প্রজন্মের সম্পাদক। কী বলা যায় এটাকে, লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন? নাকি প্রজন্ম চত্বর? গুলিয়ে যায়।
আরও পড়ুন- এক দেশ এক ভোট অবাস্তব, বোঝাল কমিশনও
দিল্লিবাসী এক অবাঙালি বন্ধু একবার খানিক খিল্লি করেই বলেছিল, “তোমাদের বাঙালীরা আর কিছু করুক না করুক প্রতিটা বাঙালি কিছু না কিছু সংস্কৃতি চর্চা করছে! কেউ কবিতা লিখছে, কেউ নাচছে কেউ গাইছে কেউ থিয়েটার করছে! সবাই এখানে নিজেকে সত্যজিৎ রায় বা রবীন্দ্রনাথ ভাবে!” সেই দিল্লিবাসী বন্ধুর কথার মধ্যে যে বেমালুম শ্লেষ আর ব্যঙ্গ মিশে ছিল সেটা বোঝার জন্য বিশেষ কসরত করতে হয়নি। সেই বন্ধুকে উত্তরটা সেদিন দিইনি। কিন্তু আজ বলতে পারি, হ্যাঁ আমার জাতিতে সবাই কিছু না করছে। সবাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সত্যজিৎ রায় হচ্ছে না। তাও দু-এক বছর অন্তরই সাহিত্য আকাডেমী বা সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কারটা আমার রাজ্যেরই কেউ না কেউ পাচ্ছে। কিন্তু আমার রাজ্যে তো অন্তত কেউ দাঙ্গাবাজ তৈরি হচ্ছে না। ব্যাঙ্কে থাকা দেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালাচ্ছে না। প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষ খুন তো করছে না! বরং সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে থাকছে। সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে ছুঁতে চাইছে। তাই বইমেলা ধুলো মেখে গার্গী-শ্রেয়সীরা আজও এককোণে বসে গিটার নিয়ে গান গেয়ে ওঠে। সেই গানের সুরে লালন থেকে লেনন মিলেমিশে যায়! কোনও এক নাম না জানা শিল্পী এক মনে পোর্ট্রেট বানায়। একঝাঁক রঙিন মুখের সারি। সবাই এখানে বইয়ের জন্য। বইকে ভালবেসে। বইমেলা স্থান পরিবর্তন করেছে বারবার৷ কখনও আকাডেমির উল্টোদিকে কখনও ময়দানে তারপর কখনও সল্টলেক স্টেডিয়াম কখনও মিলন মেলা ঘুরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং উদ্যোগে অবশেষে বইমেলা তাঁর পাকাপাকি ঠিকানা পেয়েছে।
আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে মালদ্বীপে চিনা জাহাজ
প্রবীণ এক সাহিত্যিকের সাথে কথা হচ্ছিল যিনি ১৯৭৬ থেকে ২০২৪ অবধি প্রতিটি বইমেলা দেখেছেন। বলছিলেন, এখনকার বইমেলা অনেক বেশি গোছানো অনেক বেশি পরিষ্কার। স্টলগুলোয় অনেক বেশি বড়। যাতায়াতেরও সুবিধা। শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন বাংলার সফলতম মুখ্যমন্ত্রীদের একজন বলা হয়। কলকাতা বইমেলা যখন পাকাপাকিভাবে বিধাননগরে চলে আসে তখন সবচেয়ে বেশি আপত্তি করেছিলেন যাঁরা, আজ সেই মানুষগুলোও একবাক্যে স্বীকার করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পক্ষেই সম্ভব এমন সুন্দর ব্যবস্থা করা৷ হঠাৎই মনে পরে গেল, এই যে, শিয়ালদা থেকে চালু হওয়া ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোতে করে এত লাখ লাখ বইপ্রেমী বইমেলায় নামছে, এই মেট্রো প্রকল্পটাও তো রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল! দূরদর্শী? হয়তো তাই! সপ্তাহান্তের বইমেলায় ভিড় বাড়বে। বইমেলা নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙে প্রতিবছর। বাঙালি আজও বইয়ের লোভে ছোটে। এমন একটা রাজ্য যেখানে এই অসহিষ্ণু সময়েও ২৭ কোটি বা তারও বেশি টাকার বই বিক্রি হয়। মানুষ বই পড়ে। সেই রাজ্যে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য-উপাচার্যদের সুদূর ভবিষ্যতেও একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।