‘কোন বা দোষে ইলাহি আমায়
দেয়নি নয়ন জ্যোতি,
দুঃখের তরী ভাসে নিরবধি
বিন্দু নোনাজলে হয়েছে স্রোতস্বতী’
কবির ভাষায় যাঁদের চোখ নেই, এ-আক্ষেপ তাঁদের চিরকালের! প্রাণীদেহে চোখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু দেখতে, বুঝতে, শিখতে, অনুভব করতে এবং সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। বলা ভাল এই চোখই আমাদের বেঁচে থাকার উৎসাহ দেয়— জীবন্ত প্রাণের সঙ্গে চোখের যে কী অদ্ভুত নিয়ম! চোখ বন্ধ করলেই মৃত; তাই যাঁরা জীবিত অথচ চোখে দেখেন না, তাঁদের দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই। রয়েছে কেবলই অন্ধকার নিরাশা!
আরও পড়ুন-চ্যাম্পিয়ন জাগোবাংলা, অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর
প্রাকৃতিক কিংবা নানা দুর্ঘটনার শিকারে আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায় কিংবা কমে যায়, যা কিনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনে বয়ে আনে হতাশা। অন্ধ জীবনের সেই হতাশা দূর করে আলোর ধারা বয়ে এনেছে ব্রেইল। যিনি চোখে দেখেন না, তিনি লিখতে পড়তে শিখেছেন, জেনেছেন নানা বিষয়, চিনেছেন পৃথিবী ও তার বাইরের জগৎটাকেও, লিখেছেন মনের ভাব, তুলেছেন নিজের অধিকারের কথা, জানিয়েছেন তাঁর ভাল লাগা খারাপ লাগার গল্পগুলো, দাঁড় করিয়েছেন নিজের স্বতন্ত্র ব্যাক্তিত্বকে, গড়ে তুলেছেন নিজের একটি পরিচয়, নিজের অন্ধকার জগৎটাকে সাজিয়েছেন শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয়। এই যুগান্তকারী বিপ্লবের মূল মাধ্যমই হল ব্রেইল— দৃষ্টিহীন বা দৃষ্টিশক্তি সীমিত ব্যক্তিদের জন্য তৈরি এক বিশেষ লিপি বা লিখন-পদ্ধতি, যা আঙুলের স্পর্শের মাধ্যমে পাঠ করা যায়।
ব্রেইলের অবতরণিকা
ফ্রান্সের একটি ছোট্ট গ্রাম, কু-ভ্রে, সেখানে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন লুই ব্রেইল। তাঁর বাবার ছিল ঘোড়া টানার জন্য ব্যবহৃত সাজ বা বাঁধন তৈরির দোকান, সেই কাজে দরকারি সেলাইয়ের শলাকার দুর্ঘটনায় বছর তিনের ব্রেইলের একটি চোখের দৃষ্টি চলে যায়। বিপদ এখানেই থামেনি, ক্রমশ চোখের সংক্রমণ অন্য চোখে ছড়িয়ে পড়ে এবং একসময় পুরোপুরি অন্ধত্ব তাঁর জীবনে ভর করে! ছোট থেকেই লুই ব্রেইলের জীবনে বড় হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাই দুচোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি পড়াশোনার জন্য প্যারিসে দৃষ্টিহীনদের শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান দ্যা ইনস্টিটিউট ন্যাশনাল দেস জিউনস অ্যাভিগিউলসে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ) বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি রয়েল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ নামে সুপরিচিত। ওই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা চলাকালীন মাত্র পনেরো বছর বয়সে, ১৮২৪-এ তিনি তাঁর মতো দৃষ্টিহীন কিংবা দেখতে অসুবিধা হয় এমন মানুষদের জন্য ‘ব্রেইল’-এর আবিষ্কার করেন। তাঁর এই দৃষ্টান্তমূলক কাজ ব্রহ্মাণ্ডের সকল অন্ধজনের জীবনে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল সেদিন।
চার্লস বার্বিয়ার ডে লা সেরে, একজন ফরাসি আবিষ্কারক, তিনি বিভিন্ন ধরনের শর্টহ্যান্ড এবং লিখনের অনেক বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তিনি স্লেট এবং স্টাইলাসের সাহায্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি আর্মির জন্য রাতের অন্ধকারে লেখার কথা ভেবে এক বিশেষ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। তিনি একটি প্লেট এবং সূক্ষ্ম কাঁটা-জাতীয় একটি যন্ত্র ব্যবহার করে কাগজের গায়ে ফুটো আকারে উঁচু উঁচু করে অক্ষরগুলো ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা সৈনিকেরা হাতের ছোঁয়ায় সহজেই বুঝতে পারতেন। বার্বিয়ার ভেবেছিলেন, এই ভাবে দৃষ্টিহীনরাও লিখতে-পড়তে পারে। এই বিশেষ আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হয়েই লুই ব্রেইল তাঁর নামানুসারে ‘ব্রেইল প্রযুক্তি’র আবিষ্কার করেন।
আরও পড়ুন-রোহিতই অধিনায়ক, প্রশ্ন শামিকে নিয়ে, ১২ই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল নির্বাচন
ব্রেইলের বৈশিষ্ট্য
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি স্পর্শকাতর লেখাপড়ার মাধ্যম হল ব্রেইল। এটি উত্থিত বিন্দুর মাধ্যমে অক্ষর, সংখ্যা ও চিহ্ন প্রকাশ করে। একটি ৩×২ ম্যাট্রিক্সে ছ’টি বিন্দুর সাহায্যে লেখা হয় প্রতিটি অক্ষর, সংখ্যা, এবং চিহ্নগুলো। তবে শব্দ সংক্ষেপণের জন্য কিছু অক্ষর বা চিহ্ন বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়, যা স্পেশ বাঁচায়। উচ্চতাযুক্ত বিন্দুগুলো হাতের স্পর্শে সহজেই বোঝা যায়। বিভিন্ন ভাষার জন্য উচ্চারণ ও শব্দের ভিত্তিতে স্ট্যান্ডার্ড ব্রেইল কোড বর্তমান; এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ১৩৩টি ভাষার ব্রেইল পাওয়া যায়। ব্রেইল লেখার জন্য টাইপরাইটার, ডিজিটাল এমবসার (উত্তল মুদ্রণ যন্ত্র) এবং ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ব্যবহৃত হয়। এভাবেই ব্রেইল সহজেই পাঠযোগ্য, বহনযোগ্য এবং বই, সাইনবোর্ড ও লেবেলে ব্যবহৃত হয়, যা দৃষ্টিহীনদের স্বাধীনভাবে পড়তে সহায়তা করে।
আধুনিক বিজ্ঞানের সংযোজন
নাহ্, ব্রেইল আর সেই কাগজে কলমের ব্রেইল নেই! ব্রেইল আজ ডিজিটাল হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ব্রেইলের কারিগরিও। নিরাশাগ্রস্ত অন্ধজনের জীবনে যে আলোর পথ ব্রেইল দেখিয়েছিল, আধুনিক প্রযুক্তি সেই পথকে আরও প্রশস্ত করে তুলেছে। ডিজিটাল ব্রেইলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট অব থিংস, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো বিজ্ঞান। ব্রেনহীন ব্রেইল হয়ে উঠেছে স্মার্টার। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য খুলে গেছে নতুন জগৎ। তাঁরাও বিচরণ করছে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়। প্রয়োজনে পাঠাচ্ছে ইমেল। ইন্টারনেট ব্রাউজিং, প্রিন্টিং, টাইপিং, ডিরেক্ট অডিও মেটিরিয়াল ডাউনলোডিং-এর মতো কাজগুলোও তাঁরা অনায়াসে করছেন। ডিজিটাল ব্রেইল নোটটেকারস, রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লের মতো স্মার্ট ডিভাইসগুলো ওঁদের জীবনে উন্মোচন করেছে নতুন দিগন্ত। বহু বিচিত্র ভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষের ভারতী ব্রেইলও আজ বিজ্ঞান-অভিষিক্ত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এর নির্দেশনায় আমাদের দেশে জোরকদমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে দৃষ্টিহীনদের শিক্ষা প্রদানের জন্য শুরু হয়েছে নানা আয়োজন।
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে মাও-হামলা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ, ৮ জওয়ান-সহ মৃত্যু ৯ জনের
অন্ধত্ব এবং শিক্ষার আলো
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর দ্যা প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে প্রায় ৪০-৪৫ মিলিয়ন অন্ধ ব্যক্তি রয়েছেন, তার মধ্যে প্রায় ৮-১০ মিলিয়ন ভারতবর্ষের। কম দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, পৃথিবীতে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন, ভারতবর্ষেও ৩৫ মিলিয়নের কিছু বেশি তবে সংখ্যাটা বাড়ছে প্রতিদিন।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দরকারগুলো মেটানোর তাগিদে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ধারণাটি প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো। তখন তাঁদের কোনও অ্যাসাইলামে রেখে নানারকম কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। ফরাসি মোনার্ক অন্ধ সৈনিকদের কথা ভেবে সর্বপ্রথম দ্য হসপিটাল রয়েল দেস্ ক্যুইজ ভিংতসে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এরপর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে এডিনবার্গ এবং ব্রিস্টলে তৈরি হয় অ্যাসাইলামস ফর ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ব্লাইন্ডস। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টিন হাওয়াই তৈরি করেন ফ্রান্সের রয়েল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ। তবে প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৮৩৫-তে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার স্কুল ফর দ্যা ব্লাইন্ড প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একইসঙ্গে আমাদের দেশে কলকাতায় ড. জন গুচের নেতৃত্বে তৈরি হয় কলকাতা স্কুল ফর দ্যা ব্লাইন্ড।