কিছুদিন আগেই কেরলে ন’বছরের এক নাবালিকার মৃত্যু হল। প্রবল জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় মেয়েটি। পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং মেয়েটির মৃত্যু হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগো এনসেফেলাইটিস (PAM)-এর কারণে। সোজা কথায় মেয়েটির মাথার ঘিলু খেয়ে ফেলে ফেলেছে একধরনের অ্যামিবা। মাথার ভিতরে ঢুকে এই অ্যামিবা নাকি কুরে কুরে খায় মস্তিষ্ককে! মস্তিষ্কের এক বিরল সংক্রমণ দ্রুত ডায়াগনোসিস না হলেই বিপদ। সম্পূর্ণ নার্ভাস সিস্টেমেই প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সংক্রমণে মৃত্যু হচ্ছে এমনটাই খবর। সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী কেরলে ওই একই রোগে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আরও অনেকেই। এখনও পর্যন্ত ১৯ জন মৃত, ৭২ জন আক্রান্ত। আক্রান্তের মধ্যে রয়েছে তিন মাসের শিশুও। কেরলের স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বলা হয়েছে তিন মাসের শিশুটি কী ভাবে এই বিরল রোগে আক্রান্ত হল, তা এখনও জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মনে করছেন নোংরা পুকুর, কুয়ো, জলাশয় ইত্যাদি থেকে এই রোগের সংক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা। তবে শুধু যে জল থেকেই সংক্রমণ ছড়ায়, এমনটা নয়। ওই অ্যামিবা ধুলো কিংবা মাটিতেও থাকে। গতবছরেও কেরলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছিল একাধিক। গোটা বিশ্বে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কম নয়। বিগত বছরে কলকাততেও এই রোগে আক্রান্তের কথা শোনা গিয়েছিল। এ বছরও আবার ভালমতো শোনা যাচ্ছে ব্রেন ইটিং অ্যামিবার কথা।
আরও পড়ুন-বিজেপিকে তীব্র আক্রমণ তৃণমূলের
কী এই অ্যামিবা
অ্যামিবা হল একধরনের এককোষী প্রাণী। মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবাটিও তাই। এর আসল নাম নেগেলেরিয়া ফাউলেরি (Naegleria fowleri) এছাড়া আরও একটি অ্যামিবা হয় যাকে বলে আকান্থামোয়বা (Acanthamoeba)। খালি চোখ নয়, রীতিমতো মাইক্রোস্কোপ দিয়েও এদের দেখতে হয়, তাও বেশ দুঃসাধ্য। এই প্রাণীদের পৃথিবীর আদি প্রাণী বলেও মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এই দুই জীবাণুই উষ্ণ জলে বেঁচে থাকা মুক্তজীবী জীবাণু। যারা সুযোগ পেলে মানুষের মস্তিষ্কে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই একে মস্তিষ্কখেকো বা ঘিলুখেকো ষঅ্যামিবা বলা হয়। মস্তিষ্কের বাইরে মেনিনজেস নামে একটি পর্দা থাকে। এই পর্দা বা আবরণকে ক্ষয়িয়ে দেয় এই অ্যামিবা। এর ফলে রোগী মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়। এই সংক্রমণে আক্রান্ত হলে, ব্রেন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফুলে যায় ব্রেন। চিকিৎসা হলেও নিরাময় দুরূহ। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী এই সংক্রমণে মৃত্যুর হার অনেকটাই বেশি। সাধারণত জল বা পরিবেশ থেকে নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। নাক দিয়ে ওই জলের সঙ্গে শরীরে ঢোকার পর প্রোটোজোয়ান নেগেলেরিয়া ফাউলেরি সংক্রমণ ছড়ায়। সারা বিশ্বে এতদিন এই সংক্রমণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০। অথচ গত দেড় বছরে শুধু কেরলেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১২০ জন!
আরও পড়ুন-সুদৃশ্য তোরণে সেজে উঠবে আলিপুরদুয়ার
উপসর্গ
এটি বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রমণগুলির মধ্যে একটি। সংক্রমণের ১ থেকে ৯ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলি দেখা দিতে শুরু করে।
রোগের শুরুটা হয় তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর, বমি দিয়ে এরপর দ্রুত স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয় এক্ষেত্রে। এমনকী রোগীর খিঁচুনি হতে পারে। এছাড়া যে উপসর্গ মূলত থাকে সেগুলো হল—
প্রচণ্ড মাথাব্যথা।
জ্বর এবং ঠান্ডা লাগা।
বমি-বমি ভাব বা বমি।
ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া।
হালকা সংবেদনশীলতা।
বিভ্রান্তি বা পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা।
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া।
হঠাৎ জ্ঞান হারানো, খিঁচুনি।
কোমায় চলে যেতে পারে রোগী।
নেগেলেরিয়া সংক্রমণে মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। আর জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। আকান্থামোয়েবার (Acanthamoeba) ক্ষেত্রে অসুখ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘমেয়াদি হলেও তাতে মৃত্যুর ঝুঁকি যথেষ্ট।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যদি চিকিৎসক বুঝতে পারেন কেউ এই রোগে আক্রান্ত তাহলে তাকে স্পাইনাল ট্যাপ করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। স্পাইনাল ট্যাপকে লাম্বার পাংকচারও বলে। এটা দেখে বোঝা যায় অর্গানিজমটা আপনার সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে বাসা বেঁধেছে কি না। এছাড়া ব্রেন বায়োপ্সিও করতে বলতে পারেন। মাথার কলা (টিস্যু) থেকে কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেও দেখা হয়।
চিকিৎসা
মগজখেকো অ্যামিবা একবার নাক বা মুখ দিয়ে শরীরে ঢুকলে সটান মস্তিষ্কে গিয়ে বাসা বাঁধে। মস্তিষ্কের কোষ ও স্নায়ুর দফারফা করে তবেই ছাড়ে। মস্তিষ্কে প্রদাহ এবং ফোলাভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায়শই সহায়ক থেরাপির পাশাপাশি অ্যান্টি-অ্যামিবিক ওষুধ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধ দেওয়া হয়, যা দিলে খিঁচুনি কমে যায়। ওষুধটি অ্যামিবার বিভাজন বন্ধ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রদাহ বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছলে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও দেওয়া হতে পারে রোগীকে।
সতর্ক থাকুন
গ্রীষ্মের মাসগুলিতে যাঁরা জলক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করেন, স্নান করতে বা নিখাদ আনন্দ করতে হ্রদ বা পুকুরে সাঁতার কাটেন তাঁদের খুব সতর্কতা জরুরি। এই অসুখ ছড়াতে পারে সুইমিং পুল, পুকুরের ঘোলা এবং পরিষ্কার জল দুটো থেকেই।
পুজোর সময় বেড়াতে গিয়ে অনেকেই সুইমিং পুলে স্নান করেন। বিভিন্ন রিসর্টে এখন স্নানের ব্যবস্থা থাকে। সেই জলে নিয়মিত ক্লোরিন ব্যবহার করে সংক্রমণ মুক্ত করা হয় কি না খোঁজ নিন।
যাঁরা নাক দিয়ে জল টেনে নাক পরিষ্কার করেন, তাঁরা সতর্ক থাকুন। আপনার বাড়ির জলের উৎস নিয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
সাঁতার কাটার সময় বা জলে ডুব দেওয়ার সময় এক ধরনের নোজক্লিপ ব্যবহার করুন এতে নাক দিয়ে জল প্রবেশ আটকানো যেতে পারে। মস্তিষ্কের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেন।
এই রোগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল সময়মতো রোগ চিহ্নিত করা। এর উপসর্গ ভাইরাল মেনিনজাইটিসের মতো হওয়ায় প্রায়ই রোগ শনাক্তকরণে ভুল হয়। এই অসুখের চিকিৎসা খুব জটিল। নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি নেই ফলে আগেভাগে সতর্ক থাকাই সবচেয়ে জরুরি।
উষ্ণ মিষ্টি জলে সাঁতার কাটার পর অথবা অপরিশোধিত জল ব্যবহারের পর এই লক্ষণগুলির কোনও একটি দেখা গেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।