আগামিকাল থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ বা ওয়র্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং উইক। এই সপ্তাহ পালনে এ-বছরের থিম হল ‘ক্লোজিং দ্য গ্যাপ : ব্রেস্ট ফিডিং সাপোর্ট ফর অল’।
মায়ের দুধ সদ্যোজাত থেকে তিনবছর পর্যন্ত বয়সের শিশুর পুষ্টির, সার্বিক সুস্থতার সবচেয়ে বড় উৎস। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই স্তন্যপান উপকারী।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (এএপি) এবং আমেরিকান কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস (এসিওজি)-সহ বহু বিশেষজ্ঞই প্রথম ছ’মাস শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোরই পরামর্শ দেন। ছ’মাস পেরলে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে অন্তত একবছর পর্যন্ত শিশুকে ব্রেস্ট ফিড করানো উচিত। যদি তার বেশিদিন হয় সেটা আরও ভাল।
আরও পড়ুন-বাংলার নাম পরিবর্তন নিয়ে বলতে গিয়ে মাইক বন্ধ করা হল দোলার
সদ্যোজাত শিশুকে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা অন্তর দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন। দু’মাস অতিক্রান্ত হলে প্রতি ৩-৪ ঘণ্টা অন্তর এবং ছয় মাসের শিশুকে প্রতি ৪-৫ ঘণ্টা অন্তর দুধ খাওয়ানো জরুরি।
মায়ের দুধই একমাত্র খাদ্য যা শিশুর শরীরে প্রাথমিক পর্যায়ে যাবতীয় পুষ্টিগুণের জোগানদার। মাতৃদুগ্ধ শুধুমাত্র শিশুর খাদ্য নয়, মায়ের সঙ্গে শিশুর বন্ধনের চাবিকাঠি।
জীবনদায়ী কোলোস্ট্রাম
মায়ের স্তন সর্বপ্রথম কোলোস্ট্রাম উৎপন্ন করে। এই কোলোস্ট্রাম হল একটি পুরু, হলুদ ফ্লুইড। প্রচুর প্রোটিন এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ কোলোস্ট্রামে রয়েছে ইমিউনোগ্লোবিউলিন-এ বা (IgA)। কোলোস্ট্রামে থাকা এই (IgA) শিশুর শরীরে নানা সংক্রমণের সঙ্গে লড়ে। নাকে, গলায়, পাচনতন্ত্রে এটি একটি সুরক্ষা লেয়ার তৈরি করে। এ-ছাড়া সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোমের ঝুঁকি রোধ করে মায়ের দুধ। শিশুর স্থূলতা, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ প্রতিরোধ করে।
আরও পড়ুন-২১-এর পর বরাদ্দ পায়নি বাংলা, মানল কেন্দ্র
রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে
শিশুকে বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতা, রোগের জটিলতা থেকে দূরে রাখে মায়ের দুধ। মধ্য কানের সংক্রমণ, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, সর্দি এবং ভাইরাল সংক্রমণ, অন্ত্রের সংক্রমণ, অন্ত্রের টিস্যুর ক্ষতি, অ্যালার্জিজনিত রোগ, অন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস এবং এমনকী শৈশবকালীন লিউকেমিয়া-সহ অন্য অনেক অসুস্থতা এবং রোগের ঝুঁকি কমায় মায়ের দুধ।
শিশুর স্বাস্থ্যকর ওজন বাড়ে
শিশুর অতিরিক্ত ওজনবৃদ্ধি ভাল নয়। অন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য এমনটা হয়। সদ্যোজাত শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর হল তার যে-বয়সে যে-ওজন থাকা দরকার সেটা থাকা। একমাত্র মায়ের দুধই শিশুর এই স্বাস্থ্যকর, স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী যদি কোনও শিশু চার মাসের বেশি সময় ধরে মায়ের দুধ খায় তাহলে সেই শিশুর অতিরিক্ত ওজন বা মোটা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। মায়ের দুধে-থাকা লেপটিন শিশুর শরীরে চর্বি সঞ্চিত হতে দেয় না এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে ফলে শিশুর দুধ খাওয়াও নিয়ন্ত্রণে থাকে যেটা বাইরের দুধে সম্ভব নয়। ফলে ব্রেস্ট ফিড করলে ওজন কখনওই মাত্রা ছাড়ায় না।
শিশুদের বুদ্ধিমত্তা উন্নত করে
গবেষণা অনুযায়ী যে শিশুরা জন্মের প্রথম ছ’মাস শুধু মাতৃদুগ্ধের ওপরেই থাকে সেই শিশুদের বুদ্ধিমত্তা অন্য শিশু অর্থাৎ যারা মায়ের দুধ পান করেনি, বাইরের দুধ খেয়েছে তাদের চেয়ে অনেকটাই বেশি হয়। তাদের আচরণগত সমস্যা এবং শেখার সমস্যা অনেক কম হয়। চট করে সবকিছু শিখে নেয় এবং মস্তিষ্ক অনেক কিছু সহজে ধরে রাখতে পারে। ফলে এই শিশুরা পরবর্তীতে পড়াশুনোয় যথেষ্ট সফল হয়। এমনকী প্রি-ম্যাচিওর বেবির ক্ষেত্রেও মাতৃদুগ্ধ ভীষণ কার্যকরী। তাদের যথাযথ মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায় এবং স্বাভাবিক সময়ে জন্মানো শিশুর মতোই মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক ফল দেয়।
মায়েদের জন্য উপকার
শুধু শিশু নয় মাও সমান উপকৃত হন ব্রেস্ট ফিড করালে। শিশুর স্তন্যপানে মা দ্রুত প্রেগনেন্সিজনিত দুর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। যে মায়েদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তাঁদের অস্টিওপোরোসিসের সম্ভাবনা পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পায় ব্রেস্ট ফিডিং সেই সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দেবে। সেই সঙ্গে ডিম্বাশয় বা স্তনের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিও কমায়। এছাড়া মায়েদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে স্তন্যপান করালে।
আরও পড়ুন-রাজ্যে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার প্রস্তাব, আরও বিনিয়োগ করবে আদিত্য বিড়লা গ্রুপ
ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে
সন্তান জন্মের পর বেশিরভাগ মায়ের ওজন বেশি থাকে। নিয়মিত ফিড করালে মায়ের শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন হয় এবং তিনমাস পর থেকেই ওজন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। একবছরের মধ্যে মায়ের ওজন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
জরায়ুর সংকোচনে সাহায্য করে
গর্ভাবস্থায় মায়েদের জরায়ু প্রচুর পরিমাণে প্রসারিত হয়। এতটা বেড়ে যায় যে পেটের পুরো অংশ প্রায় জুড়ে যায়। প্রসবের পর আবার সেই জরায়ু ইনভল্যুশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের আসল আকারে ফিরে আসে। অক্সিটোনিন হরমোনের সাহায্যেই এই প্রক্রিয়াটি হয়। ব্রেস্ট ফিডিং-এর সময় শরীরে এই অক্সিটোনিনের মাত্রাও বেড়ে যায়। ফলে এটি জরায়ুকে সংকোচনে সাহায্য করে। প্রসবের পরে যে রক্তপাত হতে থাকে বেশ কিছুদিন ধরে সেটাও কমায়। জরায়ু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। একই রকমভাবে প্রসবের সময়ও শরীর প্রচুর পরিমাণে অক্সিটনিন হরমোন নিঃসরণ করে বলেই রক্তপাত কম হয়।
আরও পড়ুন-২৪ ঘন্টার মধ্যেই ফের ট্রেন দুর্ঘটনা, ঝাড়খণ্ডে বেলাইন মুম্বইগামী ট্রেনের ১৮টি বগি
মায়েদের অবসাদ কমে যায়
সবচেয়ে বড় বিষয় হল প্রসবের পর পোস্ট পার্টার্ম ডিপ্রেসন বা PPD বা যাকে আমরা বেবি ব্লুজ বলি সেই অবসাদ কমাতে ভীষণ সাহায্য করে ব্রেস্ট ফিডিং। কারণ এই পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেসন বা প্রসবোত্তর অবসাদ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। অনেক মা-ই এই বদলটা মেনে নিতে পারেন না ফলে সুইসাইড করার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। মুড স্যুইং হয় মারাত্মক। কান্না পায়, রাগ হয়। এই রকম এক মানসিক পর্যায় থেকে মাকে সহজেই মুক্তি দিতে পারে স্তন্যপান।