বাব্বা! ওঁদের কত জ্ঞান। ওঁরা গরুর দুধে সোনা খুঁজে পান, গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারির অভিজ্ঞান। ওঁদের প্রজ্ঞার ধারেকাছে আমরা নেই। তবু ওঁদের কিছু কিছু কথা জানানো দরকার। নইলে ওঁরা বুঝতে পারছেন না মমতাময় বাজেটের (State Budget 2025-26) গভীরতা। গাভী-চর্চায় মগ্ন থাকলে কী আর গভীরতা বোঝা যায়!
গোড়াতেই বলে দেওয়া ভাল, নারী উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েই বুধবার ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছে মা মাটি মানুষের সরকার। এই বাজেটের অর্ধেকই নারী ও কন্যাসন্তানদের উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে। আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমাদের রাজ্য নারী সশক্তিকরণে সর্বাধিক অগ্রণী। এটা জেনে অবশ্যই আনন্দিত, বাজেটে ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক আমাদের রাজ্যের মহিলা ও কন্যাসন্তানদের জন্য বরাদ্দ। মহিলাদের উন্নয়নে এখানে গৃহীত একাধিক প্রকল্প অন্যান্য রাজ্যের কাছে আজ মডেল। এই ধারাই রাজ্যে বজায় থাকবে। মহিলাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিগত বছরগুলিতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী-সহ একাধিক প্রকল্প চালু করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এছাড়াও মহিলাদের স্বনির্ভরতার জন্যেও একাধিক প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য সরকার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে পর্যাপ্ত অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে তাঁদের কাজের সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে নবান্ন। আর সেই লক্ষ্যেই এবারের বাজেটে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির তৈরি পণ্য বাজারজাত করতে বিশেষ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যে বর্তমানে কয়েক লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী রয়েছে। একাধিক মেলায় জায়গা করে দিতে তাঁদের তৈরি পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয় রাজ্য সরকার। এবার প্রতি জেলা সদরে একটি করে শপিং মল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। সেই মলের দুটি করে তল শুধু মাত্র স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের জন্য রাখা হবে বলেই এবারের বাজেটে (State Budget 2025-26) ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের বাজেটে এই বাবদ বরাদ্দ ১৫০ কোটি টাকা।
এছাড়াও নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যের সব থেকে বড় প্রকল্প হল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ২০২৪-২৫ অর্থ বর্ষে এই প্রকল্পের উপভোক্তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২১ লক্ষ। প্রত্যেক মাসে এই প্রকল্পের অধীন তফসিলি জাতি ও উপজাতির উপভোক্তারা ১২০০ টাকা এবং অন্যদের এক হাজার টাকা করে দেয় রাজ্য। এই প্রকল্পের জন্য ২০২৪-২৫ যেখানে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, সেটাই ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বাড়িয়ে ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করা হল। একই ভাবে কন্যাশ্রী প্রকল্পে এই অর্থ বর্ষে ১৫ লক্ষ ৭৫ হাজার ছাত্রীকে এক হাজার টাকা করে বার্ষিক বৃত্তির জন্য নথিভুক্ত হয়েছে আর ২৫ হাজার টাকা করে এককালীন সুবিধার জন্য ২ লক্ষ ছাত্রীর নাম নথিভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও রূপশ্রী প্রকল্পে চলতি অর্থবর্ষে এককালীন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে ২ লক্ষ ৮ হাজার মহিলাকে। যার জন্য খরচ গিয়েছে ৫০৪.২৫ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, এই তিনটি প্রকল্পের রূপায়ণের দায়িত্বেই রয়েছে নারী ও শিশুবিকাশ এবং সমাজ কল্যাণ দফতর। উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থ বর্ষে এই দফতরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ২৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। যেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে এই দফতরের বাজেট প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন- ঋত্বিক ঘটকের ছবি বন্ধ করেনি তৃণমূল, প্রধান শিক্ষকের চিঠিতে ফাঁস ‘গণশক্তি’র মিথ্যাচার
আর একটি কথা। চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) রাজ্য সরকারের নিজস্ব আয় গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। জিএসটি-সহ বিভিন্ন কর খাতে গতবছর রাজ্যের আয় হয় ৮৯ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তা বেড়ে ৯৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা হয়েছে এবছর। এর মধ্যে জিএসটি থেকে সবচেয়ে বেশি— ৪৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা আয় হয়েছে। গতবছর জিএসটি থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ভূমিরাজস্ব, স্ট্যাম্প ডিউটি, আবগারি, বিক্রয় কর-সহ বিভিন্ন কর খাতে আয় বেড়েছে। আগামী অর্থবর্ষে (২০২৫-’২৬) রাজ্য সরকারের নিজস্ব কর থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব আয় অল্প বেড়ে ৩২৮৬ কোটি টাকা হয়েছে।
অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের উপর বোঝা না চাপিয়ে সরকারের আয় বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ও কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করেই সম্ভব হয়েছে এটা। ইলেকট্রনিক ওয়ে বিল, উৎস থেকে কর আদায় ব্যবস্থার সংযুক্তিকরণ, জিএসটি সুবিধা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। আয়বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে এগুলি। বিরোধ নিষ্পত্তি স্কিম চালু করে ২৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা গিয়েছে।
মনে করিয়ে দিই, বাম সরকারের শেষ বছরে (২০১০-’১১) রাজ্যের নিজস্ব কর বাবদ আয় ছিল মাত্র ২১ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। এই ব্যাপারে ২০২৫-’২৬ সালের জন্য ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে নিজস্ব আয়বৃদ্ধির পরিমাণ হবে ৫.৩৩ গুণ। বাজেট নথি আরও বলছে, কেন্দ্রীয় করের অংশ বাবদ রাজ্যের আয়ও বেড়েছে। ২০২৩-’২৪ সালে এই খাতে রাজ্য সরকারের আয় হয় ৮৪ হাজার ৯৭১ কোটি। ২০২৪-’২৫ সালে তা হয়েছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা।
সিজিএসটি, আয়কর, কর্পোরেট কর, কাস্টমস প্রভৃতি কেন্দ্রীয় কর খাতে রাজ্যে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তার ৪১ শতাংশ রাজ্য সরকারগুলি পেয়ে থাকে। রাজ্য সরকার এটা বাড়িয়ে অন্তত ৫০ শতাংশ করার দাবি তুলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অনুদান খাতে রাজ্যের প্রাপ্য ২২ হাজার ৭২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৮ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা হয়েছে। সব খাত মিলিয়ে ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে রাজ্যের আয় ২৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২ লক্ষ ২৭ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা হয়েছে। ঋণ পরিশোধ খাতে রাজ্য সরকার এবছর ৭৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। আগামী বছরের জন্য ঋণ পরিশোধ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা পাওয়া যায়নি। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথা ঝোঁকাবেন না। মানুষের পাশ থেকে সরে যাবেন না। তারপরেও সমালোচনা করেছেন ওঁরা কোন মুখে?