বিজেপি মুক্ত বাংলা গড়ুন: আর কতদিন এভাবে চালাবেন? আর কতদিন এভাবে জ্বালাবেন?

মোদি অমিত শাহর আমলে সবাই নিজভূমে পরবাসী। সন্দেহবাতিক রাষ্ট্র ভারত এখন। সৌজন্যে অন্য কেউ নয়, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দল। বঙ্গ ও বঙ্গীয় সংস্কৃতি বিষয়ে এদের আগ্রহের অভাব, জ্ঞানের অভাব, সুস্পষ্ট। আর বিজেপি যে বাংলার মণীষীদের বিষয়ে কতটা অজ্ঞ কিংবা তাঁদের বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত শ্রদ্ধার অভাব যে দলটির ডিএনএতে রয়েছে, সে প্রমাণও ইদানিং বিস্তর মিলেছে। তাই, বিজেপি মুক্ত বাংলা চাই আমাদের। সেটাই ধর্ম - বর্ণ - নির্বিশেষে আপামর বাঙালির এই সময়ের দাবি। লিখছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

কয়েকজন বাঙালি মনীষী আছেন যাঁরা কেবল মনস্বী নন, বাঙালির এক একটি আবেগ বিশেষ। এঁদের প্রতি সামান্যতম অবহেলা, অসম্মান বাঙালি কোনও দিনই মেনে নিতে পারে না।শ্রীরামকৃষ্ণকে ‘ ঠাকুর‘,বিদ্যাসাগরকে ‘করুণাসাগর’, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে ‘সাহিত্যসম্রাট’, রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, বিবেকানন্দ সম্পর্কে ‘স্বামীজি’ আর প্রফুল্লচন্দ্র ও জগদীশচন্দ্রকে ‘আচার্য’ বলে সম্মান জানাতেই অভ্যস্ত বাঙালি। সেই ঐতিহ্য পরম্পরা না জেনে, বাংলা (BJP Free Bengal) দখলের জন্য মরিয়া মোদির মুখে শোনা গেল, তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘ দাদা ‘ সম্বোধনে সম্বিধিত করছেন। বোঝা গেল,এটাও তাঁকে বঙ্গ বিজেপির কেউ শেখায়নি, বাঙালি ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ কালচারে অভ্যস্ত হওয়ার আগে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি ‘বাবু’ সম্বোধনটা ছিল সম্মানসূচক। অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ‘দেবী’ সম্বোধন করার রীতি ছিল। তবে একেবারে পারিবারিক পরিসরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোত্রের ব্যক্তিদের ‘দাদা’ সম্বোধন করা হয়ে থাকে। সেদিনকেও, আজও। পরিবারবহির্ভূত জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকেও ‘দাদা’ সম্বোধনের প্রচলন থাকলেও তার সীমাবদ্ধতাও লক্ষণীয়। রবীন্দ্র – বঙ্কিম – বিদ্যাসাগর – বিবেকানন্দের গোত্রভুক্ত ব্যক্তিদের কোনওভাবেই ‘দাদা’ সম্বোধন করা চলে না। তাঁদের ‘দাদা’ সম্বোধনে সম্মানপ্রদর্শন যথাযথ তো হয়ই না, বরং তাঁদের স্তরটা নামিয়ে আনা হয়।প্রতিটি ভাষা ও সংস্কৃতির মতো বাংলা ও বাঙালির কিছু নিজস্ব রীতি আছে। সেই ভাষা ও সংস্কৃতিভুক্ত ব্যক্তিকে, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে, তা অনুসরণ করে চলতে হয়। কোনও একটি ভাষা ও সংস্কৃতি একা বিকশিত হতে পারে না। এজন্য দরকার হয় অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন গড়ে তোলা। স্মর্তব্য, সংস্কৃতি হল সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। বস্তুগত সম্পদ কিছু দিলে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এখানেই মাহাত্ম্য সাংস্কৃতিক সম্পদের। এই সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিলেও কমে না, বরং পারস্পরিক শ্রীবৃদ্ধির পরিসর বৃদ্ধি পায়, ঠিক যেমন জ্ঞানবিজ্ঞান। সাংস্কৃতিক বিনিময় কতটা হয়েছে তা বোঝা যায়, আমরা প্রতিবেশীর সংস্কৃতি কতটা আত্তীকরণ করতে পারলাম তার কিছু নমুনা দেখে। যদি একজন হিন্দু প্রতিবেশী মুসলিম রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন এবং ভাববিনিময়ের সময় তা পালন করেন তবে তা ভালো প্রতিবেশীর নমুনা হয়ে ওঠে। বিষয়টি বিপরীত দিক থেকেও সত্য। এটা শুধু হিন্দু বা মুসলমানের ব্যাপার নয়, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আর এখানেই যত গন্ডগোল। ‘দিবে আর নিবে মেলাবে মিলিবে’র সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত নয় বিজেপি। সুতরাং, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদের ভিতরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার মন্ত্র তথা জাতীয় গীত ‘বন্দে মাতরম্‌’-এর স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধন করে বসেছেন! এবং সেটা একবার নয়, একাধিকবার! ফলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে এমনটা ভেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছাকৃভাবে কিংবা জেনে বুঝে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে অসম্মান করেছেন, এমনটাও হয়তো নয়। এই ভোটের বাজারে তো নয়ই । কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ‘বিপর্যয়’ প্রত্যাশিত ছিল না। এবং এই বিপর্যয় থেকে বঙ্গ ও বঙ্গীয় সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর আগ্রহের অভাব, জ্ঞানের অভাব, সুস্পষ্ট।

আরও পড়ুন-একঘেয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজন বদল, শহরে এসে দাবি শুভাংশুর

আর বিজেপি যে বাংলার মণীষীদের বিষয়ে কতটা অজ্ঞ কিংবা তাঁদের বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত শ্রদ্ধার অভাব যে দলটির ডিএনএতে রয়েছে, সে প্রমাণও বিস্তর মিলেছে। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত। লোকসভার ভাষণে সাহিত্যসম্রাটকে তিনি ‘বঙ্কিম দাস চ্যাটার্জি’ নামে চেনালেন! অনুরাগ ঠাকুর ‘ বন্দেমাতরম ‘ কে একাধিকবার ‘বন্দে ভারত ‘ বলে উল্লেখ করলেন।

সব মিলিয়ে বোঝাই গেল, ভারতের মতো সুবৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রের শাসক পক্ষের চেহারা বড়ই করুণ। বিরোধীদের উদ্দেশে অগ্নিবর্ষণ করতে গিয়েই মোদিজি অ্যান্ড কোং কালিমালিপ্ত করে বসলেন সংসদের গরিমাকে।
সেই সঙ্গে এটাও বেআব্রু হয়ে পড়ল যে রাজনীতিক হিসেবে নরেন্দ্র মোদি যত বড় ‘ধুরন্ধর’ তার চেয়ে ঢের বেশি অজ্ঞ নিজের দেশ এবং দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে। হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান জপ করতে করতে ভারতের বহুত্বের সাধনার আদ্যশ্রাদ্ধ করে বসেছে গেরুয়া বাহিনী (BJP Free Bengal)।

তারা কেবল এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত যে, ভারতে ‘ভারতবাসী’ কেবল বিজেপির ঝাণ্ডাধারীরা। বকিরা উর্দুভাষী হলে ‘পাকিস্তানের দালাল’ আর বাংলাভাষী হলে ‘বাংলাদেশি’! অর্থাৎ সবাই ‘বিদেশি’! নিজের দেশের মানুষের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করেই সময় এবং সম্পদ নষ্ট করছে বিজেপি সরকার, মোদি পক্ষ। অথচ এই মানুষগুলিকে দিয়েই এবং এই অর্থ ও সম্পদেই রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে গড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেসব হচ্ছে কই! সব ঝামেলায় গিয়ে পড়ছে আদালতের ঘাড়ে। দুর্যোগ দুর্ভোগই অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠছে নিরীহ নির্দোষ নাগরিকের। ক্ষমতার মদে মত্ত মোদি বাহিনীর, পদ্মপক্ষের, লোকজন শুধু যন্ত্রণাই দিতে পারে, তাদের গেরুয়া ঝুলিতে তার বেশি আর কিছুই নেই। আর এই জিনিস চলতে থাকলে এইদেশে কেউই বাস করতে পারবে না স্বস্তিতে। সেই দেওয়াল লিখন রোজ স্পষ্টতর হচ্ছে।

Latest article