এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে। আজও চিরনবীন এই মন্ত্রে আপামর বাঙালি কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় মায়ের আবাহন করেন। লক্ষ্মী মানে আপাতভাবে মনে হতে পারে ধনসম্পদের কথা। কিন্তু আদতে কি তাই? বলাবাহুল্য, লক্ষ্মী মানে শুধু অর্থ নয়। লক্ষ্মীলাভ মানে সামগ্রিকভাবে সুখশান্তিতে ভরপুর হওয়া। গৃহলক্ষ্মীর পাশাপাশি দীর্ঘ পথচলার সঙ্গী নারায়ণেরও সমৃদ্ধি লাভ। আর বাংলার ঘরে ঘরে যিনি রক্তমাংসের লক্ষ্মী-নারায়ণকে সুখশান্তির ডোরে বেঁধেছেন তিনি আমাদের সবার প্রিয় একান্ত ঘরের মেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ খরা কাটিয়ে মমতার মমতাময়ী স্পর্শে বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত লক্ষ্মীলাভ হয়েছে। রাজ্য ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে বাংলার।
আরও পড়ুন-বৃষ্টিতে পণ্ড প্রথম দিনের খেলা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের জোয়ারে একে একে বাংলা তথা বাঙালিকে পরিপূর্ণ করেছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো বিশ্বজয়ী প্রকল্প। এর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত কন্যাশ্রী প্রকল্প তো ‘জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লভিছে’ রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনে তাই পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে স্বমহিমায় উজ্জ্বল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীরাও। যে আলোয় বাংলার মহিলারা গৃহলক্ষ্মীর রূপ পেয়েছেন। লক্ষ্মীর আশীর্বাদে পরনির্ভরশীলতা কমেছে। জীবনে এসেছে আত্মনির্ভরতার বিশ্বাস। লক্ষ্মীর পাঁচালি আর মমতাময়ীর একের পর এক উন্নয়ন সমার্থক হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলার লক্ষ্মীরাই নন, গৃহস্বামী নারায়ণরাও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে অংশগ্রহণ, রাজ্যের সহায়তায় নানা ব্যবসাবাণিজ্যে যোগদান করে স্বনির্ভরতার উড়ানে চেপেছেন।
আরও পড়ুন-ঘুরে আসুন পশ্চিমে
এবারের দুর্গাপুজোয় দক্ষিণ কলকাতার অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি পুজো প্যান্ডেল হপিং করতে গিয়ে চোখ টেনে নিল লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সার্থক রূপায়ণ। থিম-সাগরের সৌন্দর্যে ডুবে যেতে যেতে আরও একবার উপলব্ধি করছিলাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরদর্শিতার ‘ড্রিম’কে। এখানে তো লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পুজোর থিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পুজো সাঙ্গ হলে সেই থিম পর্ব শেষ। বড়জোর কার্নিভ্যাল পর্যন্ত টানা যাবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বীজ বপন করেছেন বাংলায় তা সুদূরপ্রসারী। এখনই রাজ্যের দু-কোটির অনেক বেশি মহিলা এই প্রকল্পের অধীনে এসে গিয়েছেন। প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সে সংখ্যা। এমনিতে মহিলারা পাচ্ছেন মাসে হাজার টাকা করে। আর আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটাই ১২০০ টাকা।
আরও পড়ুন-প্রতিমা নিরঞ্জনের পর নদী সাফাই রায়গঞ্জ পুরসভার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে বাংলার সেরা উৎসব দুর্গাপুজো আন্তর্জাতিক দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একটা সময় পর্যন্ত দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তারা ভাল মতো জানতেন পুজো করা কতটা চাপের। কয়েকটি হাতে গোনা বড় পুজো ছাড়া বেশিরভাগ পুজো কমিটির অবস্থাই ছিল তথৈবচ। শারদ উৎসব বাঙালির সেরা পার্বণ। অথচ ঠিকমতো ফান্ড জোগাড় করতে না পেরে পুজোগুলোর রীতিমতো ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ দশা। কাঁহাতক চাঁদা আর যৎসামান্য বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে চালানো যায়। দিনের পর দিন প্রতিমা থেকে প্যান্ডেল, আলোকসজ্জার বাজেট বাড়ছে। এদিকে ভাঁড়ার ফাঁকাই থেকে যাচ্ছে। দুর্গাপুজো তো আর শুধুমাত্র পুজোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একে কেন্দ্র করে সুবিশাল বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হয় সমগ্র বাংলায়। সে প্রতিমা,প্যান্ডেল,আলোক থেকে পোশাক-আশাক, খাদ্যখানা, পর্যটন একে অপরের হাত ধরাধরি করে আছে। এর মূল ভিত পুজোটা ঠিকমতো করতে পারলে তবেই তো আনুষঙ্গিকগুলো হইহই করে দৌড়বে। ব্যস! দূরদৃষ্টিসম্পন্না মুখ্যমন্ত্রী আয়োজকদের এই সমস্যা বুঝলেন এবং ততোধিক দ্রুততার সঙ্গে পুজো কমিটিগুলির জন্য রাজ্যের অনুদানের ব্যবস্থা করলেন। সংখ্যার পরিমাপে এইমুহূর্তে কলকাতার দুর্গাপুজোর আয়োজক ক্লাব পাচ্ছে ৮৫ হাজার টাকা। নিশ্চিতভাবে বাংলা ও বাঙালির পুজোর পরিকাঠামোকে চাঙ্গা করে তুলেছে মুখ্যমন্ত্রীর এই সদর্থক পদক্ষেপ। নিঃসন্দেহে কলকাতা তথা রাজ্যের পুজোকে কয়েক ল্যাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে বর্ণাঢ্য কার্নিভ্যালের কথাও। বস্তুত, বাংলার পুজো এতদিন পর্যন্ত একটা গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কার্নিভ্যালের হাত ধরে বিশ্বায়নের স্রোতে সেই পুজো আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে।
আরও পড়ুন-নিষেধাজ্ঞার আড়ালে দাপট বাড়ছে চোলাইয়ের, নীতীশের বিহারে বিষাক্ত মদে মৃত ৬
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার অনেক আগেই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যকে একের পর এক নতুন রেল প্রকল্পে মুড়ে দিয়েছিলেন। রাজ্যটাকেও তিনি উন্নয়ন মডেলের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সেধেছিল তৎকালীন মান্ধাতা মানসিকতার বামফ্রন্ট সরকার। তবে কথায় আছে, সদিচ্ছা থাকলে ঠিক উপায় আছে। জনতা জনার্দনের রায়ে যেদিন নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন থেকে দেখিয়ে দিলেন কাজ কাকে বলে। কাজ না বলে বলা ভাল কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, যুবশ্রী— কী নেই। এর মধ্যে কন্যাশ্রী তো রীতিমতো বিশ্ববন্দিত।
সারাদিন খেটেখুটে গলদঘর্ম হয়ে যে মা লক্ষ্মীরা বাড়ি ফেরেন তাঁদের কথা পুজোর ভিড়ে আমাদের মনে পড়ে কি? অথচ সকাল-সন্ধ্যা পাঁচুর মা-কে না পেলে ঘরগৃহস্থালী শিকেয় ওঠে। আজকের ছোট পরিবারসর্বস্ব জীবনে এই পাঁচুর মা-দের গুরুত্ব অপরিসীম। সত্যি বলতে কী এঁদের জীবনযাপন সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই। আমরা যে সারাদিন ব্যস্ত। অথচ আমাদের পরিবার এঁদের ছাড়া অচল। শুধু ঘরে পরিচারিকার কাজ বলে নয়,বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁরা। ওঁদের স্বামীরাও পিছিয়ে নেই। জীবনসংগ্রামের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তাঁরাও নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন। প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুরের কথায় ‘ওরা কাজ করে’।
২০১১-তে বাংলার মসনদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই চাকাটা ঘুরতে আরম্ভ করেছে। বাম জমানার স্বৈরাচার আর থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় মনোভাবে বাংলার লক্ষ্মীশ্রী প্রায় উবে গিয়েছিল। সেই লক্ষ্মীদের নতুন করে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলার উন্নয়নের দিশারি মানবিক মুখ্যমন্ত্রী।
পাঁচুর মা-দের এখন একটা মাসিক রোজগারের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত হয়েছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আনুকূল্যে দিব্যি ব্যাঙ্কে প্রতি মাসে ঢুকে যাচ্ছে হাজার টাকা। টাকার পরিমাপের এই হাজার টাকা সাম্মানিক হিসেবে লক্ষ-কোটি টাকার সমান। তার আগে ৩৪ বছর নামেই বামফ্রন্ট সরকার ছিল রাজ্যে। আসলে ছিল সিপিএম। রাজ্যের আবালবৃদ্ধবনিতা কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাতেই আসত না। গরিব-গুর্বো মানুষকে বোকা বানিয়ে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা সংবলিত ইলেকশন ম্যানিফেস্টো ছিল সেকালের সবচেয়ে বড় ধাপ্পা। মুখে হাজার গণ্ডা প্রতিশ্রুতি আর কাজের বেলায় দাঁত কপাটি— এই ছিল তৎকালীন নাম-কা-ওয়াস্তে বামপন্থীদের ভনিতা। বাম জমানার সেই অ-লক্ষ্মীর বিদায় ঘটেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুশাসনে। আগামীতে যে এই লক্ষ্মীরা মহালক্ষ্মী হয়ে উঠবেন তা বলাইবাহুল্য।