নাৎসি জার্মানি হোক বা ফ্যাসিস্ত ইতালি, সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে জাতীয়তাবাদের দুটি ধাপ লক্ষিত হয়। এক, স্বদেশের প্রতি অকৃত্রিম প্রীতি ও আনুগত্য। দুই, অপর জাতিগুলিকে নিজেদের থেকে আলাদা করে দেখা, এক ধরনের বৈরী থেকে তাকে দেখা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, নিজের প্রতি বা আপন জাতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা ভালবাসার বোধ আত্মহত্যার নামান্তর। এই স্বাজাত্যপ্রীতি মনুষ্যত্ববোধ বর্জিত, নৈতিকতার বোধবিহীন স্বাদেশিকতার চর্চা। অন্ধ রাষ্ট্রপ্রীতি কেবল ক্ষমতার রাজনীতির পথ প্রশস্ত করে। এই ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ সামরিক সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। তাই ঘটে চলেছে একের পর এক ঘটনা। দেশের নানা প্রান্তে। নানা রূপে।
আরও পড়ুন-যোগীর জঙ্গলরাজ, ৪ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে খুন লখনউতে
রাজস্থানে মিষ্টিপ্রেমীদের জিভে জল আনা কয়েকটা মিষ্টির সঙ্গে জুড়ে ছিল ‘পাক’ শব্দটি। কিন্তু আমরা এখন প্রবল পাকিস্তান- বিরোধী। তাই মোতিপাক বা মহীশূরপাক নামে ‘পাক’ শব্দের ওপর কোপ পড়েছে। রাজস্থানের রাষ্ট্রবাদী মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ‘সবার আগে দেশ’। তাই, মোতিপাক এখন মোতিশ্রী। মহীশূরপাক মহীশূরশ্রী। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ধমনীতে যাদের রক্তের বদলে গরম সিঁদুর বহমান, কে তাদের বোঝাবে, ফারসি ‘পাক’ শব্দের অর্থ ‘পূত’, ‘পবিত্র’, সেই অর্থের প্রতিফলন পাকিস্তান নামে, কিন্তু ভারতীয় ভাষায় ‘পাক’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পচ্’ ধাতু সঞ্জাত। ফারসি ‘পাক’ বিশেষণ, কিন্তু ‘পচ্’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে ‘পাক’ এতদিন মহীশূরপাক বা মোতিপাকে ছিল, সেটি বিশেষ্য পদ। তার অর্থ ‘অগ্নিতাপে রন্ধন’।
কে ওদের মনে করিয়ে দেবে মহীশূরপাকের ইতিহাস? ১৯০২ থেকে ১৯৪০ মহীশূরের শাসক ছিলেন ওদেয়ার বংশীয় কৃষ্ণ রাজা। ভোজনবিলাসী এই রাজার পাচক ছিলেন কাকাসুরা মাদাপ্পা। তিনি ময়দা, ঘি আর শর্করা দিয়ে খাবার তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে তৈরি করে বসলেন একটি দারুণ সুস্বাদু মিষ্টান্নের। কৃষ্ণরাজা সেই মিষ্টি খেয়ে দারুণ খুশি। তিনিই তাঁর শাসিত রাজ্যের নামানুসারে এটির নাম দেন ‘মহীশূরপাক’।
অর্থাৎ, এসব মিষ্টির সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও সংযোগ নেই।
আর আমরা, যারা সিঁদুরে মেঘ দেখে ঘরপোড়া গরুর মতো ভয় পাচ্ছি, তাদের আরও আশঙ্কা, এরকমটা চলতে থাকলে আমাদের বঙ্গদেশীয় নরমপাক সন্দেশ, কড়াপাক সন্দেশ অচিরেই নরমশ্রী, কড়াশ্রী নামে পরিচিত হবে। জিভে তার স্বাদ এক লাগলেও কানে তার নাম হোঁচট খাবে।
নাগপুরে আক্রান্ত ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতা। মহারাষ্ট্রের একদল শিল্পী ও সমাজকর্মী ‘হাম দেখেঙ্গে’ পাঠ করার দায়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫২, ১৯৬ ও ৩৫৩ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। অভিযোগকারী দত্তাত্রেয় শিরকে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী।
ফৈজ পাকিস্তানি কবি। ‘অপারেশন সিঁদুর’-উত্তর ভারতে পাকিস্তান একটি পরম না-পাক দেশ। তাই তার সবকিছু, ম্যায় কবিতাও বর্জ্য।
আসল কথাটা কিন্তু অন্য।
আরও পড়ুন-বিজেপির অসমে ‘এনকাউন্টার-কালচার’, উদ্বেগ সুপ্রিম কোর্টের
উল্লিখিত ‘নাজম’-এর তৃতীয় পঙক্তি না কি ভারতের জাতীয় সংহতি বিরোধী, সেখানে ঠাসা রয়েছে দেশদ্রোহিতার বারুদ। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হাম্ এহল-এ-সাফা, মারদুদ-এ-হায়াম, মসনদ পে বিঠায়ে জায়েঙ্গে, সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে।’
সাদা বাংলায় এই পঙক্তিটির অর্থ : আমরা যারা ন্যায়ে বিশ্বাস করেছিলাম, ন্যায়ে বিশ্বাস রাখার জন্য নির্বাসিত হয়েছিলাম যারা পুণ্যভূমি থেকে, তারা লাভ করব আশার অক্ষয় আসন। তখন সব মুকুট খসে পড়বে, পতন হবে সব সিংহাসনের।
এই লাইন এখন হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ‘জেহাদি উচ্চারণ’, আবার পাকিস্তানের মুসলমান মৌলবাদীদের কাছে এই লাইনই হয়ে উঠেছিল ‘বিধর্মী প্রচারণা’। জিয়াউল হক থেকে পারভেজ মুশারফ, যাবতীয় সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের আওয়াজ হয়েছে এই লাইন। আবার এদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে এনআরসি, সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে প্রতিবাদী ঠোঁট গেঁথে নিয়েছে এই পঙক্তিগুলোই।
দেশ-কাল-বিহীন শাশ্বত প্রতিবাদী চেতনার এই পঙক্তিতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন হিন্দুত্ববাদীরা। অনায়াসে, পাক কবির লেখা বলে সেটার ওপর কোপ নেমে আসছে।
বিশ্বাস করুন, এই আগ্রাসন-আক্রমণে কোনও আপত্তি ছিল না, যদি না আমরা ঘর পোড়া গরুরা এই ঘটনায় সিঁদুরে মেঘ দেখতাম ভিন্ন কোণ থেকে।
এরকমটা অব্যাহত থাকলে অচিরেই আক্রান্ত হবেন রবীন্দ্রনাথও। কোপ পড়বে তাঁর রচনাতেও। তিনি লিখেছিলেন, ১৯০৮-এ বন্ধু এ এম বোসকে লেখা একটি চিঠিতে, “দেশপ্রেম চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক আশ্রয় হতে পারে না। আমার আশ্রয় মানবতায়। আমি হীরের দামে কাচ কিনি না এবং যতদিন বেঁচে থাকি, কখনোই দেশপ্রেমকে মানবতার ওপর বিজয়ী হতে দেব না।” তিনি বলেছিলেন, ‘পথ ও পাথেয়’তে, সুস্পষ্টভাবে, “আমি যাহা করিব সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব সকলকেই তাহা বলিতেই হইবে, এইরূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত ও আচরণ-বৈচিত্রের অপঘাত মৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্বলাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়াছি।” তার ওপর আছে ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’ ও ‘গোরা’। বিজেপি-মার্কা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের বিপ্রতীপে সেসব উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রদের অবস্থান, তাদের মুখে অজস্র রাবীন্দ্রিক চিন্তা দর্শনের বুলি।
তাই ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর ওপর কোপ পড়ার এই প্রহরে, আশঙ্কিত আমরা নিশ্চিত, গরম সিঁদুরের এই জমানায় রবিঠাকুর মানব শরীরে এই ধরাধামে থাকলে তাঁর অনিবার্য ঠিকানা হত, তিহার জেল!
আমাদের সজাগ থাকতেই হবে।