চুরির পেছনে, চোর-পরিচয়ের পেছনে সভ্য-অসভ্য তত্ত্বের বিষয়টা ধরে ফেলেছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু। ‘কালাচাঁদ’-এ তিনি লিখেছেন, ‘চুরি কে না করে? মিথ্যা কথা কে না কয়? বঞ্চনা কাহাতে নাই?… ছোটলোক সিঁধ কাটিয়া চুরি করে, আর বড়লোকে কথার কৌশলে, বুদ্ধির জোরে চুরি করে। আমরা অসভ্য চোর, তাহারা সভ্য চোর।’ ইদানীং দুজনের ‘চোর’ পরিচয় নিয়ে দেশ জুড়ে শোরগোল উঠেছে।
এক, কৃষ্ণের মাখন চুরি। দুই, বিজেপির ভোট চুরি। এই দুজনের মধ্যে যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর কথা অনুযায়ী কোন জনকে সভ্য চোর বলব আর কোন জন অসভ্য চোর, তাই নিয়ে আমরা রীতিমতো ‘কনফিউজড’। বিজেপির এক মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, কৃষ্ণকে ‘মাখন চোর’ বলা যাবে না। কারণ, সম্ভবত, সুরদাস কর্তৃক সংকলিত ‘সুর সাগর’-এ স্বয়ং কৃষ্ণ বলেছেন, ‘মাইয়া, ম্যায় নহি মাখন খায়া’। নররূপী হলেও ভগবান দুষ্টুমির ছলে মিথ্যা বলতে পারেন না।
আবার, মোদি-শাহ-নির্বাচন কমিশন একেবারে ভগবানপ্রতিম। তাঁদের কোনও অস্বীকরণকে ভুয়ো কথা বলার অধিকার এদেশের কারও নেই।
আরও পড়ুন-কলেজিয়ামের সুপারিশ নিয়ে ভিন্নমত এবার সুপ্রিম কোর্টেই, আঞ্চলিক ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন
এদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ বিড়াল বলছে, ‘চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী’। সে আরও বলে, ‘অধর্ম চোরের নহে, চোরে যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর’। এখন প্রায় একইরকম কথা শুনিয়েছেন মোহন যাদব। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। মধ্যপ্রদেশ বিজেপি-শাসিত রাজ্য। সুতরাং, সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলের ধর্মীয় নীতি- সাম্প্রদায়িক আদর্শ মেনেই কৃষ্ণের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কাজে নেমেছেন। মোহন যাদব বলছেন, কৃষ্ণকে ‘মাখনচোর’ বলা যাবে না। তার কারণ দ্বিবিধ। এক, কৃষ্ণ ভগবান। ‘ভগবানকে আবার চোর বলা যায় নাকি!’ ওই, বিজেপি আবার চোর হতে পারে নাকি গোছের যুক্তি।
দুই, কৃষ্ণ বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান ছিলেন। চুরি করার কোনও দরকার ছিল না তাঁর। স্মর্তব্য, কমলাকান্তের বিড়ালও বলেছিল, ‘খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেক চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না।’
সেই বিড়াল এটাও বলেছিল, ‘কিন্তু তাঁহাদের (তথাকথিত সাধুদের) প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোর চুরি করে।’
মোহন বলেছেন, একেবারে গেরুয়া ঘরানার স্বকপোলকল্পিত ইতিহাসের সূত্র মেনে বলেছেন, ‘সেই সময়ে হাজার হাজার গোরুর দুধ থেকে মাখন তৈরি করে মথুরায় পাঠানো হত। মথুরার রাজা তখন কংস। মাখনের হাঁড়ি ভেঙে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন কৃষ্ণ। গোপাল (শ্রীকৃষ্ণনের অষ্টোত্তর শতনামের অন্যতম) রাখালদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তোমরা মাখন খেয়ে নাও। তারপর হাঁড়ি ভেঙে ফেলো। কিন্তু মনে রেখো, একটা হাঁড়িও যেন শত্রুদের হাতে না যায়”।
একেবারে গেরিলা যুদ্ধের পোড়ামাটি নীতি। এতে, প্রতিবাদের এই ধরণে যে চরমপন্থী বিপ্লবী নীতির ছায়া প্রলম্বিত, সেটা হয়তো মোহন যাদব মহাশয় লক্ষ করেননি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চৌর্য বিষয়ক আলোচনায় সমকালীন ভারতবর্ষে আমরা দুটি সিদ্ধান্ত, স্পষ্টত এখনও অবধি পেয়েছি। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদিকে ‘ভোট চোর’ বলা যাবে না। এ নিয়ে গোদি মিডিয়া বলে স্বীকৃত একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে কিছুদিন আগেই বেজায় গোলমাল দেখেছিলাম আমরা।
কৃষ্ণকে ‘মাখনচোর’ বলা চলবে না। কারণ, মোহনের ব্যাখ্যায়, যেমন মন থেকে রাগ-অহঙ্কার, ঘৃণা, হিংসা, লোভ, অহং ইত্যাদি নেচিবাচক বৈশিষ্ট্যের অপসারণের প্রতীক হল ‘মাখনচুরি’, ঠিক তেমনই আমাদের মতো সাদামাটা আমজনতার দৃষ্টিতে, ক্ষমতার স্বাদ চেটেপুটে খাওয়ার লোভ, ক্ষমতার অহংবোধ, বিরোধী মতের প্রতি হিংসা ও ঘৃণা প্রকাশের সাফল্য সূত্র হল বিজেপির ‘ভোটচুরি’।
কিন্তু এসব প্রতীকী তাৎপর্যের গোলমেলে উপস্থাপনায় ‘চোর’ শব্দটির উৎস ও বিবর্তন, শব্দার্থের রূপান্তর সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা-আলোচনায় ছেদ পড়ছে।
আরও পড়ুন-আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরেছি : সূর্য
‘চোর’ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে দেখা যাচ্ছে, রয়েছে ‘চুর্’ ধাতু, যেটির অর্থ ‘চুরি করা’। সেটির সঙ্গে ‘নিচ্’ প্রত্যয় যোগ হয়ে উৎপন্ন হচ্ছে ‘চোরি’ শব্দটি। তার সঙ্গে ‘কর্তৃ’ অর্থে ‘অ’ যোগ হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে ‘চোর’ বিশেষ্যটি। বৈদিক যুগে ‘চোর’ বলতে অনার্যদের বোঝানো হত। অনার্য, অসভ্য সেই ‘চোর’ তস্কর হল দক্ষিণভারতে অর্থবিকারের সৌজন্যে।
অসভ্য, অনার্য জনজাতি ‘চোয়াড়’ বাংলার জঙ্গলমহল অঞ্চলের ভূমিপুত্র, আদিবাসী। ১৭৯৯-তে এঁরা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন রাণি শিরোমণি। উল্লিখিত ‘চোয়াড়’ বা ‘চুয়াড়’ শব্দটিও এসেছে ‘চোর’ থেকে।
ডি ডি কোসাম্বির গবেষণায় ও আলোচনায় প্রকাশিত অনুরূপ ভাবনার প্রতিফলন। তিনিও বলছেন, পুরাণের কৃষ্ণ আর বেদের কৃ্ষ্ণণ অভিন্ন নন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে কৃষ্ণের ঐশীত্ব অর্জন এবং সেটি মূলত ‘মহাভারত’-এর সৌজন্যে। এই মহাকাব্যটির আগে কৃষ্ণ একজন উপজাতীয় পুরুষ ছিলেন। অর্থাৎ, প্রাক- মহাভারত পর্বে অনার্য এবং দেবতা নন, এমন ব্যক্তি বা চরিত্র ছিলেন কৃষ্ণ।
অনার্য পরিচয়ে আপত্তি থাকলে অন্য কথা, নচেৎ উৎসগত অর্থে কৃষ্ণের ‘চোর’ হওয়াটা মোটেই আপত্তিজনক বিষয় নয়। বরং, ইতিহাসসিদ্ধ একটি সত্য। সেটিকে আড়াল করার চেষ্টাই বরং কৃষ্ণের ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
‘চোর’ বা ‘মাখনচোর’ কৃষ্ণচরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই কৃষ্ণের ছেলেবেলার সঙ্গে, গোপাল-বেলার পর্বে, মাখনচুরির কাহিনি কেবল ভাগবত পুরাণে নয়, জৈন গ্রন্থ, ‘পুষ্পদন্ত’ এমনকী জিনসেনের ‘হরিবংশ’-এও উল্লিখিত। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় এবং প্রতীকী তাৎপর্যেই মাখিনচুরি প্রসঙ্গ উল্লিখিত। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক পণ্ডিত-গবেষক জন স্ট্র্যাটন হাওলি এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, মাখনচুরি আসলে ভালবাসা চুরি। ননী চুরি প্রকৃত অর্থে প্রেম চুরি। গাভী তার বাছুরটিকে ভালবাসে বলেই তার শরীরে, বাঁটে দুধ আসে। সে দুধ বা প্রেম যখন ঘন হয়, তখনই তা মাখনে পরিণত হয়। কাঁচা দুধ থেকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত মাখন তাই ঘনত্ব সত্ত্বেও সহজ-সরল। এই সহজিয়া সারল্য উপভোগ করার প্রণোদনাতেই কৃষ্ণের প্রেমচুরি। এটা ভক্তির তত্ত্ব। তাই এই চুরিতে পরের দ্রব্য অপহরণের ভাবনা নেই, আছে প্রেমভক্তি রস আস্বাদনের ব্যাকুলতা। বিরোধ না থাকলে প্রেমের স্বাদ কমে যায়। কামড় বা আঁচড় না থাকলে জাগতিক ভালবাসা বিস্বাদ হয়ে পড়ে। সেই ভাবনার প্রশ্রয়েই কৃষ্ণর চুরি করে মাখন খাওয়া। তাছাড়া, এই চুরিতে যতটা না অপরাধ মনস্তত্ত্ব ক্রিয়াশীল, তার চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে দুষ্টুমির উপাদান। শিশু সুলভ আচরণ। এজন্যই ব্রজভূমে ‘মাখনচোর’ সম্বোধনে কৃষ্ণের ভাবমূর্তির অবমাননা করা হয় না, বরং তাঁর ‘চোরি’ উদযাপিত সাড়ম্বরে, উৎসবের আকারে। মাখনচোর কৃষ্ণ তাই অনার্য ভারতের ভূমিপুত্র হতে পারেন। মাখনচোর কৃষ্ণের আচরণ তাই আমাদের ঘরে ঘরে যে সব ‘লাড্ডো গোপাল’ আছে তাদের সরল দুষ্টুমি হতে পারে। নিছক পরদ্রব্য অপহরণকারীর তকমা দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, এমন কোনও উৎপাতের ছায়া তাতে পড়ে না। ভোটচুরি ততটা নিরীহ ব্যাপার নয়। তার জন্য যে গণতান্ত্রিক জীবনে উৎপাত বাড়ে, সেটা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।