মঙ্গলের বুকে পৃথিবীর গাড়ি

Must read

অর্পণ পাল: মঙ্গলগ্রহ নিয়ে আমাদের আগ্রহ অনেক দিনের। পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার দূরের এই পাথুরে শুষ্ক লালচে গ্রহের দিকে যাওয়ার চেষ্টাও মানুষ করে যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। না, কোনও মানুষের পা এখনও এই গ্রহে না পড়লেও মানুষের তৈরি যন্ত্রযান ভাইকিং -১ এই গ্রহের মাটি স্পর্শ করে প্রথমবার, ১৯৭৬ সালে।

আরও পড়ুন- এমবাপে কি তবে ক্লাব ছাড়ছেন, জল্পনা তুঙ্গে
তারপর পাথফাইন্ডার, স্পিরিট, অপরচুনিটি, সোজার্নার, এরকম বেশ কয়েকটি যন্ত্রযান এই গ্রহের বুকে নেমেছে বিভিন্ন দেশের প্রচেষ্টায়, আর ভালো করে লক্ষ্য করে এসেছে লাল গ্রহের আবহাওয়া বা পরিবেশকে। সত্যিই কি বহুকাল আগে এই গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল? হয়ে থাকলে সে কেমন প্রাণ? সে কি মানুষের মতো কোনও উন্নত জীব?

আরও পড়ুন- কেন্দ্রের দুই মন্ত্রকের আইনি লড়াইয়ের জেরে হাইকোর্টে আটকে রয়েছে জোকা-বিবাদি বাগ মেট্রো
এসব প্রশ্নেরই উত্তর স্পষ্টভাবে দিতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। তাই তো এত খরচ, এত পরিশ্রম করে তাঁরা যন্ত্রযান পাঠিয়ে চলেছেন বহু দূরের এই গ্রহের উদ্দেশ্যে। আর আমেরিকার মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসা ইতিমধ্যেই তো ঘোষণাও করেছে, আর বছর কয়েক বাদেই তারা মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পাঠাবে মানুষসমেত মহাকাশযান। তার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
ইতিমধ্যে মঙ্গলের বুকে ঘটে চলেছে নানা কাণ্ডকারখানা। যেমন নাসারই এক মঙ্গলযান ‘কিউরিওসিটি’ সৌরমণ্ডলের চতুর্থ গ্রহের দিকে রওনা দেয় ন বছর আগে, ২০১১ সালে, অ্যাটলাস-৫ রকেটে চেপে। সে মঙ্গলে পৌঁছয় ২০১২-র আগস্টে। সেই থেকে গোটা নটা বছর ধরে সে হেঁটে চলেছে এই ধূসর গ্রহের বুকে। এখনো পর্যন্ত সে মঙ্গলের বুকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পথ হেঁটেছে, আর সংগ্রহ করেছে বত্রিশরকমের পাথুরে নমুনা। নবম বর্ষে পা দিয়ে এবার সেই খুদে গাড়ি এমন এক জায়গায় পৌঁছল, যেখানকার পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম।

আরও পড়ুন- কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি, শ্যামাপ্রসাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও কি তবে ফ্রিজ করতে চলেছে পুলিশ?
নানা ধরনের খনিজ লবণ, সালফেট জাতীয় যৌগ ইত্যাদিতে ভরা সেখানকার মাটি।
গেল নামে এক গিরিখাতের মধ্যেকার ওই এলাকা, বিজ্ঞানীদের অনুমান, বহু বছর আগে এত শুষ্ক ছিল না। কিন্তু সেইসময়কার আর্দ্র ভিজে আবহ কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুষ্কতায় রূপ পেল, সেই পরিবর্তনের যাত্রাপথ বোঝার ক্ষেত্রে এই পাথুরে শুষ্ক মাটিকে বিশ্লেষণ করাটা খুব জরুরি।

আর সে কাজে তাঁরা ইতিমধ্যে অনেকটাই এগিয়েছেন। মঙ্গলের বুকে দেড়শো কিলোমিটার লম্বা ওই গেল গিরিকন্দরের (gale crater) মধ্যে অনেককাল, প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে এক বিরাট আকারের হ্রদ ছিল, এ ব্যাপারে তাঁরা এখন নিশ্চিত। আর ওই হ্রদের মধ্যেকার পরিবেশ প্রাণধারনের উপযুক্ত ছিল হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল জুড়ে। বাতাসও ছিল এমন, যাতে জল তরল আকারে থাকতে পারে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও সেখানে আদৌ প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল কি না, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিউরিওসিটির সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করলে সে ব্যাপারে তথ্য মিলবে বলে ওঁদের আশা।

আরও পড়ুন- মোদি সরকারের ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন চরম জনবিরোধী, মুখ খুলল তৃণমূল কংগ্রেস
৯০০ কেজি ওজনের কিউরিওসিটি নিয়মিত পৃথিবীতে ছবি, ভিডিও বা অন্য ধরনের বার্তা পাঠিয়েই চলে, যা ছ’চাকা বিশিষ্ট ওই যন্ত্রগাড়ির সঙ্গে পৃথিবীতে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের যোগাযোগের মুখ্য বাহন। অন্য মহাকাশগাড়ির মতো কিউরিওসিটি সৌর শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। তার শক্তির উৎস তাপ। যা সে পায় তার মধ্যে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্লুটোনিয়ামের আকরিকের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে উৎপন্ন তাপ থেকে। ওই তাপকে সে তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে নেয়। কিউরিওসিটির মধ্যে চোদ্দ বছর চলার মতো শক্তি উৎপাদন আর সঞ্চয়ের মতো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যে কারণে আরও বেশ কয়েক বছর ও ওখানে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারবে।

আরও এক মঙ্গলগাড়ি পারসিভের‍্যান্স
………
পরবর্তীকালে পারসিভের‍্যান্স রোভার নামে আরও একটি মঙ্গলযান যুক্ত হয় কিউরিওসিটির সঙ্গে। দশ ফুট লম্বা, ৯ ফুট চওড়া আর সাত ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এই গাড়িটি মঙ্গলের বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছে পৃথিবী থেকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রযুক্তির মাধ্যমে। আর ওই গ্রহের আবহাওয়া থেকে সংগ্রহ করছে নমুনা, যা সে পাঠাবে নাসার পরবর্তী মহাকাশযানে চাপিয়ে।

আরও পড়ুন- বুধবার নবান্নে ইস্টবেঙ্গল-শ্রী সিমেন্টের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী

মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে রকেটে চেপে এই যন্ত্রযান রওনা দেয় আগের বছর জুলাই মাসে, আর এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলের ‘মাটি’ স্পর্শ করে সেই এসইউভি আকারের যন্ত্রগাড়ি পারসিভের‍্যান্স।
মঙ্গলের আবহাওয়া, ভূতাত্বিক উপাদান ইত্যাদি নানা ধরনের বিষয় বিশ্লেষণ করাই তার কাজ। জলীয় স্তরবিশিষ্ট মঙ্গলের বুকে অতীতে কখনও আণুবীক্ষণিক প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিলে কি না, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোও তার আর এক কাজ। আর গত দীর্ঘ ছ’মাস ধরে মঙ্গলের জেজেরো গিরিখাতের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো এই যান গত ৬ই আগস্ট প্রথমবার সেই গ্রহের বুকে গর্ত খোঁড়ে। উদ্দেশ্য, মঙ্গলের মাটি সংগ্রহ করা।

প্রায় আট সেন্টিমিটার গভীর গর্ত খোঁড়ার কাজটা সে ঠিকঠাকভাবেই করেছিল, এরপর ওই নমুনাকে টিউবের মধ্যে ভরে সিল করে যন্ত্রযানের ভেতরেই রেখে দেওয়ার কথা; যাতে পৃথিবী থেকে বছর কয়েক বাদে পরবর্তী মহাকাশযান গিয়ে পারসিভের‍্যান্সকে নিয়ে এলে ওই নমুনাও বিজ্ঞানীদের হাতে আসে। কিন্তু যন্ত্রযানের মধ্যে নমুনাভর্তি টিউবটাকে নিয়ে আসবার পর সেটাকে যখন পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখতে চাইলেন, তখন তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন, টিউবের ভেতর পুরো ফাঁকা!
তাঁদের অনেকের অনুমান, রোভারটি (অর্থাৎ যন্ত্রযানটি) যখন যান্ত্রিক হাত দিয়ে গর্ত খুঁড়ে টিউবে পাথুরে নমুনা ভরতে যায়, তখন ওই টিউবে কোনও কারণে শুধু নরম গুঁড়োজাতীয় কিছু পদার্থ ঢুকে যায়, যা পরে টিউবের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে।

তবে কি হতাশাই ভবিতব্য?
…………….
তবে মহাকাশবিজ্ঞানীরা এতে মোটেই হতাশ হচ্ছেন না। তাঁরা জানেন, ওই যন্ত্রযানে রয়েছে আরও ৪৩টা ওরকম টিউব। ইতিমধ্যেই ওই গাড়ি এলাকা পরিবর্তন করে আরও পাথুরে এলাকা খুঁজে বের করেছে, আবার মঙ্গলের মাটি খুঁড়ে নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করবে, যা পৃথিবীতে আনতে পারলে চাঁদের পাথর আসবার পর দ্বিতীয় কোনও মহাজাগতিক স্থানের নমুনা পৃথিবীতে আসবার কৃতিত্ব অর্জন করবে। সত্যিই যদি সেটা ঘটে, সে হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আর সে ঘটনা আমরা আর বছর কয়েক পরেই প্রত্যক্ষ করতে পারব, এ কথা ভাবলেই রোমাঞ্চিত হতে হয়।

Latest article