হু (WHO)-এর মতে বিশ্বের প্রায় ২.২ বিলিয়ন মানুষের কোনও না কোনও দৃষ্টির সমস্যা রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ১ বিলিয়ন মানুষ ছানি বা অন্য কোনও কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। জন্মেই চোখে ছানি রয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে ভারতে। দেশের ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ৬ জন চোখে ছানি নিয়েই জন্মায়। সমীক্ষা অনুযায়ী পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ছানি বেশি হয়। তাই প্রতি বছর জুনে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব ছানি সচেতনতা মাস।
আরও পড়ুন-প্রকাশের জন্মদিনে কন্যা দীপিকার অভিনব উদ্যোগ, ১৮ শহরে ৭৫টি ব্যাডমিন্টন সেন্টারের উদ্বোধন
ছানি কী
ক্যামেরার লেন্সের মতো আমাদের চোখের ভেতরেও একটি লেন্স রয়েছে যার সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে আমরা দূরের ও কাছের জিনিসকে স্পষ্ট দেখতে পাই। এই লেন্সটি অস্বচ্ছ হলে আমরা চোখে ঝাপসা দেখি। এমনকী কোনও কোনও সময় কিছুই দেখতে পাই না। লেন্সের এই ঝাপসা হয়ে যাওয়াই ছানি পড়া বা ক্যাটারাক্ট। ছানি পড়লে চোখের লেন্স ঘোলাটে বা মেঘলা হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
উপসর্গ
আবছা এবং ঘোলাটে দৃষ্টি অর্থাৎ বস্তুগুলি অস্পষ্ট লাগে এবং দৃষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয়।
আলো এবং ঝলকের প্রতি সংবেদনশীলতা। উজ্জ্বল সূর্যের আলো, হেডলাইট, এমনকী ঘরের ভিতরের আলোও অস্বস্তি এবং দেখতে অসুবিধার কারণ হয়।
রাতের বেলা দেখতে অসুবিধে হয়। কম আলোতে বা রাতের বেলায় গাড়ি চালানোর মতো কাজে অসুবিধা হয়।
বিবর্ণ বা হলুদ রং। রঙগুলি তাঁদের প্রাণবন্ততা হারাতে পারে, নিস্তেজ দেখাতে পারে বা মুছে যেতে পারে।
পড়া এবং লেখার হরফ বড় এবং পড়তে বেশি আলোর প্রয়োজন হয়।
একই জিনিস একসঙ্গে দুটো দেখা বা ডাবল ভিশন।
উজ্জ্বল আলোর চারপাশে একটা চক্র বা বলয় বলয় দেখা।
চশমার পাওয়ার ঘন ঘন বদল হওয়া।
ছানি পড়ার কারণ
ছানি পড়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল বার্ধক্য। লেন্সের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে প্রোটিন ভেঙে যায় এবং তা মেঘলা হয়ে যায়, ফলে ছানি পড়ে।
কোনও কারণে চোখে আঘাত লাগলে পরবর্তীতে ছানি পড়ে।
পারিবারিক ইতিহাসে থাকলে সম্ভাবনা থাকে।
অনেকদিন ধরে বেশিমাত্রায় ডায়াবেটিস থাকলে ছানি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়।
ইউভি এক্সপোজার অর্থাৎ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে দীর্ঘক্ষণ থাকলে চোখের লেন্সের ক্ষতি হয়।
যে কোনও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের দীর্ঘদিন ব্যবহার ছানি হওয়াকে তরান্বিত করে।
ধূমপান এবং মদ্যপানের দীর্ঘস্থায়ী অভ্যেস চোখের ক্ষতি করে ছানির ঝুঁকি বাড়ায়।
কম বয়সেও ছানি পড়ে
ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড থাকলে কম বয়সে ছানি পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বংশগত কারণেও অল্প বয়সে ছানি পড়ে। এছাড়া অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস অর্থাৎ অ্যালার্জি থেকে বয়সের আগেই ছানি পড়তে পারে। আবার মায়োটনিক ডিস্ট্রফি থেকেও ছানি পড়ে সময়ের অনেক আগেই। এই রোগটি হলে পেশির কর্মক্ষমতা কমে যায় বৃদ্ধ হওয়ার আগেই দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। যাঁদের হাই মাইনাস পাওয়ার অর্থাৎ হাই মাইওপিয়া রয়েছে বা চোখের ক্রনিক সংক্রমণ হয় অথবা রাতকানা রোগ রয়েছে তাঁদেরও কম বয়সে ছানি পড়ার ঝুঁকি বেশি।
আরও পড়ুন-পকেটমারের থেকেও দ্রুততম ধোনির হাত
শিশুদের ছানি
শিশুদের ছানি যা পেডিয়াট্রিক ছানি নামেও পরিচিত। এই ছানি জন্মগত বা জন্মের পরেও হতে পারে। এক্ষেত্র শিশুর চোখ ট্যারা হয়, ঠিকমতো ফোকাস করতে পারে না, চোখ নড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
ছানির ছ’টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে
কর্টিকল ক্যাটারাক্ট : কর্টিকল ছানি সাধারণত শুরু হয় চোখের লেন্সের বাইরে কোনা থেকে এবং সেন্টারে দিকে বাড়ে। দৃষ্টির সমস্যা তৈরি হয়।
ইনটুমেসান্ট ক্যাটারাক্ট : ইনটুমেসান্ট ছানির ক্ষেত্রে চোখের লেন্স ফুলে যায় ভিতরে জল জমে ফলে হঠাৎ করে ভিশন লস হতে শুরু করে।
নিউক্লিয়ার ক্যাটারাক্ট : নিউক্লিয়ার ছানির ক্ষেত্রে লেন্সের একেবারে মাঝখানের অংশকে প্রভাবিত করে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়, দূরের বস্তু অস্পষ্ট দেখায়।
পোস্টরিয়র সাবক্যাপসুলার ক্যাটারাক্ট : পোস্টরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানিতে লেন্সের পিছনের দিকে ছানি তৈরি হয় এবং দ্রুত বাড়ে। ফলে চোখের সামনে ঝলকানি আসে, পড়তে অসুবিধে হয়।
রোজেট ক্যাটারাক্ট : রোজেট ছানির ক্ষেত্রে চোখের লেন্সে তারার মতো প্রতিচ্ছবি আসে। চোখের ওপর আঘাতে লেন্সের তন্তুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে এমনটা হতে পারে।
ট্রমাটিক ক্যাটারাক্ট : চোখে কোনও ধারালো কিছু ঢুকলে যেমন পেনসিল, কাচের টুকরো ইত্যাদি এছাড়া রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে এসে বা বৈদ্যুতিক শক লাগলে, রেডিয়েশন এক্সপোজার হলে লেন্সের ক্ষতি হতে পারে। খেলতে গিয়ে চোখে লেগে গেলে চোখের ক্ষতি হয় এবং পরবর্তিকালে ছানি পড়তে পারে।
চিকিৎসা
শিশু হোক বা বৃদ্ধ, ছানির চিকিৎসার একমাত্র উপায় হল অস্ত্রোপচার। এই অস্ত্রোপচারে চোখের প্রাকৃতিক লেন্সটিকে একটি কৃত্রিম লেন্স (IOL) দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
ছানি অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক বা প্রায় স্বাভাবিক হয়। ঘোলাটে দৃষ্টি বা অন্য সমস্যা দূর হয়। উন্নত লেন্স দিলে চশমা-পরা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
ছানি অপারেশন হওয়ার পর সতর্কতা জরুরি। প্রথম সাতদিন চিকিৎসক যা বলবেন সচেতনভাবে মানতে হবে। এরপর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে টিভি দেখা, বই পড়ার মতো দৈনন্দিন কাজ করলেও তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। অস্ত্রোপচারের পরেই কিছুদিন ভারী কিছু তুলবেন না। সাঁতার কাটা যাবে না। চোখে হাত দেওয়া যাবে না কোনওভাবেই। লক্ষ্য রাখতে হবে অন্তত মাসখানেক যেন জোরে হাঁচি বা কাশির কারণে চোখে কোনও ঝাঁকুনি না লাগে।
ছানি প্রতিরোধ করবেন কীভাবে
চল্লিশের ওপর বয়স হলে অন্তত ছ’মাসে একবার চোখ দেখানো জরুরি।
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড থাকলে শুরু থেকেই সতর্ক হোন।
সবসময় ভাল ইউভি প্রতিরোধী রোদচশমা ব্যবহার করুন।
বাড়িতে কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার করুন। স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করুন যাতে চোখে কম চাপ পড়ে।