মাতৃভাষায় ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’

হ্যাঁ! বাঙালির গর্বের মায়ের আরাধনা। বাঙালির ঐতিহ্যের মতোই বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস বস্তুত সুদীর্ঘ এবং পরিবর্তনশীল। অকালবোধন থেকে শুরু করে জমিদার বাড়ির প্রাচীন পুজো— সবই রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে গত কয়েক বছরে নতুন রূপ পেয়েছে। লিখছেন শ্রেয়া বসু

Must read

ধূম্রনেত্র বধে দেবী ধর্ম কামার্থ দায়িনী।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি||

শরৎ-এর পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আর দুগ্ধশুভ্র কাশফুলের দিকে তাকালেই বাতাস জুড়ে শুধুই দুর্গাপূজার মৃদু গন্ধ— আমাদের দুর্গাপুজো, উৎসবের আনন্দ ও উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয়ে থাকা শত-সহস্র বাঙালির দুর্গাপুজো। এ-যেন বাঙালিয়ানার মোড়কে শিউলি-শুভেচ্ছা। হ্যাঁ! বাঙালির গর্বের মায়ের আরাধনা। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সন্ধ্যার পাখিদের মতো বাসায় ফিরছে বিদেশ-বিভূঁইয়ে থাকা প্রবাসীরা। উৎসবের আনন্দে গন্ধ শুধুই বাঙালিয়ানার। যদিও কর্মসূত্রে বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরাও কিন্তু নিজস্ব প্রথা মেনে দুর্গাপুজো জমিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ব জুড়ে বাঙালির দুর্গাপুজোর প্রভাব বেশ গভীর, শিকড়ের টানের মতো।

হিন্দু ধর্মীয় কোনও কাজই শাস্ত্র-বহির্ভূত নয় সেটা আজ অজানা নয়। তবে বাঙালি ঐতিহ্যের মতোই বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস বস্তুত সুদীর্ঘ এবং পরিবর্তনশীল। অকালবোধন থেকে শুরু করে জমিদার বাড়ির প্রাচীন পুজো— সবই রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে গত কয়েক বছরে নতুন রূপ পেয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে দুর্গার মহিষাসুর বধ এই পুজোর মূল ভিত্তি। বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরুর পর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ এই প্রথা শুরু করেন। পরবর্তীকালে, কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপুজো শুরু করেন এবং ১৯ শতকে এটি একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপুজো আয়োজিত হয়। এই পুজো আজও সগৌরবে হয়ে আসছে। নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায় দুর্গোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসব উদযাপনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হন। বাড়ে কর্মসংস্থান। বাংলার আবেগেই সমস্ত মানুষ একত্রিত হন। আর সেই মিলনে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সেরা দিকগুলি প্রতিনিয়ত নতুনভাবে মেলে ধরছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার দুর্গোৎসব তথা শারদোৎসবের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে উদ্যোগী হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। ১৫ ডিসেম্বর ‘হেরিটেজ’ তকমা পায় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সেরা প্রাণের উৎসব।

আরও পড়ুন-সবে তো শুরু, কোচের সঙ্গে বার্তা গুরপ্রীতেরও

মায়ের উপাসনার মূল ভিত্তি হল কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবৎ এবং বৃহৎনন্দীকেশ্বর পূরাণ। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্তমানে দুর্গাপ্রতিমার বিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও গৌরবময় মূল পুজো পদ্ধতি কিন্তু মমতাময়ী ছায়ায় আজও অপরিবর্তিত। ঐতিহাসিক ২০১১! এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহিমান্বিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালীদের দুর্গাপুজো সময়ের সঙ্গে সর্বসাধারণের হয়ে উঠেছে। তাঁর মৃদু হাতের ছোঁয়ায় প্যান্ডেল-আলো-থিম-বিনোদন, আধ্যাত্মিক ও অন্তরের প্রাণশক্তি ক্রমশ নতুন দিগন্ত খুঁজে পাচ্ছে। তবে এবারের দুর্গাপুজো অনন্য। থিম ‘বাংলা ভাষার অসম্মান নয়, বাঙালির হেনস্থা নয়’। দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় যখন বাংলা ভাষা ও বাঙালির বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণের খবর শিরোনামে, তখন বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসবকেই প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করলেন মুখ্যমন্ত্রী। শহরের দুই প্রাচীন দুর্গাপুজো কমিটি এবার তাদের থিমের মূল ভিত্তিই বেছে নিল বাংলা ভাষা। বর্ষার দিনে চপ–মুড়ি সহযোগে আড্ডা বাঙালির অনন্ত প্রেম। তৃপ্তির উৎস। সেই থিম অবলম্বন করেই হচ্ছে এবারের মাতৃবন্দনা। গত কয়েকশো বছরে বাংলা হরফের বিবর্তন, শুরুর যুগের চর্যাপদের বিবর্তন হয়ে আজকের বাংলা ভাষাই তাদের এবারের পরিকল্পনা।

তবে এত কিছুর মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। কলকাতায় বসবাসকারী অবাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয় তাই বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবে অবাঙালিদের দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। দুর্গাপুজো তাঁর কাছে সৌহার্দের বার্তা। তবে এর মাঝেই এবার দুর্গাপুজোই হতে চলেছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় প্রচারমাধ্যম। পালাবদলের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের পুজো উদযাপনকে নতুন মাত্রা দেওয়ার পাশাপাশি কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পুজো কার্নিভালের সূচনা করেছেন ৷ ২০২১ সালে ইউনেস্কো দুর্গাপুজোকে Intangible Cultural Heritage বা অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ায় তাঁর মর্যাদা রক্ষাতেই মুখ্যমন্ত্রীর নতুন পরিকল্পনা ‘দুর্গাঙ্গন’। এ-যেন শুধু একটি স্থাপনা নয়, হতে চলেছে বাঙালির উৎসব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক স্থায়ী আস্তানা। এই কেন্দ্র যে দেশ-বিদেশের পর্যটক টানবে এবং দুর্গাপুজোকে ঘিরে রাজ্যের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পকে নতুন গতি দেবে সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আরও পড়ুন-বীরভূমের ৩ মহকুমায় রাজ্যের অগ্নিনির্বাপণ দফতরের উদ্যোগ, গড়ে উঠবে নতুন ৫ দমকল কেন্দ্র

অতএব ভালর আলোতে মগ্ন থাকার উৎসবে বাংলায় ঐতিহ্যের রাংতায় মুড়ে আলোকিত হোক অন্ধকার অলিগলি। উৎসবের মধ্যে পরশপাথর খোঁজার মতো মানুষ খুঁজে নিক স্নিগ্ধতা, পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার সেই চিরন্তন স্নিগ্ধতা। অপার সারল্যে তাঁরা ছুটে চলেছে ধোঁয়া-ওঠা ট্রেন লক্ষ্য করে। অধরাকে ছুঁতে না পারলেও ওই দৌড়েই তাদের আনন্দ। ঠিক তেমনই মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরপণায় বাঙালি সত্তার অবস্থান অন্তরের অন্তঃপুরে। সেই পথ পর্যন্ত পাড়ি দেওয়ার রাস্তা খুঁজে দেয় উৎসব। নির্দ্বিধায় খুঁজে নেয় আমাদের মনের ভিতরের সারল্য মাখানো অপু-দুর্গাদের। নস্টালজিয়া, প্রেম, বিস্তীর্ণ মাঠ, কাশফুল আর শৈশবের সাক্ষী থেকে যায় এই উৎসব। কালের নিয়মে অপু-দুর্গারা হারিয়ে যায় যান্ত্রিকতার ভিড়ে, মুঠোফোনে বন্দি হয়ে যায় শৈশব। উৎসব হয়ে ওঠে ব্র্যান্ডেড জামা-কাপড়ের সমাহার, দামি রেস্তোরাঁয় স্পেশ্যাল ডিশ। তারপরে নিমেষেই সব হারিয়ে আবার বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে মনকে। টিকে যায় শুধুই বাংলা, বাঙালিয়ানা আর চিরন্তন বাঙালি ঐতিহ্য, পরম্পরা।

Latest article