শুরু থেকেই মননশীল পাঠকের সমাদর পেয়েছে ‘কবিসম্মেলন’। কবির কাগজ কবিতার কাগজ। পেরিয়েছে দুই দশক। রেখেছে একুশে পা। বিভিন্ন সময়ে উপহার দিয়েছে অনবদ্য সংখ্যা। প্রবীণদের পাশাপাশি প্রকাশ করেছে নবীনদের লেখা। সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ এই সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। নিজের লেখা-কর্ম সামলে তিনি সযত্নে লালন করে চলেছেন এই পত্রিকাটি। ছড়িয়ে পড়েছে সুবাস। দেশে, বিদেশে। বাংলা কবিতা সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন এই পত্রিকার কথা। মসৃণ ছিল না যাত্রাপথ। এসেছে ঝড়ঝাপটা। তবে টলানো যায়নি। বাংলা ভাষা, বাংলা কবিতার কাছে দায়বদ্ধ এই পত্রিকা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। এগিয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন-ভুয়ো বোমার হুমকি নিয়ে কেন্দ্রের সতর্কতা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে
অন্যান্য বছরের মতো ‘কবিসম্মেলন’-এর এবারের শারদীয় সংখ্যটিও এককথায় অসাধারণ। কবিতা তো আছেই, সেইসঙ্গে আছে কবিতা বিষয়ক বেশকিছু গদ্য রচনা। শুরুতেই সৌরীন ভট্টাচার্যর গদ্য ‘ডায়েরি : রঘুবংশম্ মঙ্গলাচরণ’। সংস্কৃত ভাষার প্রতি ঝরে পড়েছে গভীর শ্রদ্ধা। ‘একটুখানি রিলকে’ রচনায় অমিয় দেবের অনুবাদে পড়ার সুযোগ হল রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা। দুটো সনেট, একটা এলিজি। ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যুশতবর্ষ পূর্ণ হল এই বছর। অসাধারণ এই স্রষ্টা নিজের ক্ষমতার প্রতি ছিলেন সংশয়ী। জানা গেল শেখর বসুর ‘নিজের লেখার নির্মম সমালোচক’ লেখা থেকে। মধুসূদন দত্তের কবিতা লেখা শুরু হয়েছিল ইংরেজিতেই। তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত কলকাতার সমকালীন ইংরেজি পত্রিকায়। ‘ইংরেজি ভাষায় লেখা মধুসূদনের কবিতা ও কাব্য’ রচনায় জানিয়েছেন সুমিতা চক্রবর্তী। কালীকৃষ্ণ গুহ-র ‘সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কয়েকটি কথা’ প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এক গভীর রচনা। আলোচনা করা হয়েছে কিছু কবিতার উপর। এ ছাড়াও নানা বিষয়ের গদ্য রচনা উপহার দিয়েছেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল ঘোষ, হিরণ মিত্র, সৈয়দ কওসর জামাল, মজিদ মাহমুদ, যশোধরা রায়চৌধুরী, প্রবালকুমার বসু, তৃষ্ণা বসাক, শংকর চক্রবর্তী, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, শরণ্যা মুখোপাধ্যায়, পার্থজিৎ চন্দ প্রমুখ। কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেছেন মোস্তাক আহমেদ। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঠাকুরের ভ্রমণ এবং অমৃতা ভট্টাচার্যর কাব্যনাটক মন ছুঁয়ে যায়। কবিতা লিখেছেন বাংলা ভাষার প্রতিনিধি স্থানীয় কবিরা। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় পবিত্র সরকার, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, চিন্ময় গুহ, দেবাশিস মহন্ত, সুবোধ সরকার, রণজিৎ দাশ, শ্যামলকান্তি দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, সুধীর দত্ত, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, সুজিত সরকার, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, ঈশিতা ভাদুড়ীর নাম। ৩৮৮ পৃষ্ঠার সুসম্পাদিত একটি সংখ্যা। ছাপা, কাগজের মান, বাঁধাই উন্নতমানের। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ। দাম ২৫০ টাকা।
আরও পড়ুন-ঘরের মাঠে শুরু হল পাওয়ার-প্লে, মহারাষ্ট্রের ভোটে সম্মানরক্ষার লড়াই
ছোটগল্পের সম্পূর্ণ পত্রিকা ‘নতুন গল্পপত্র’। শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে শংকর চক্রবর্তীর সম্পাদনায়। ‘গল্পকথা’য় সম্পাদক স্মরণ করেছেন কমল চক্রবর্তীকে। এরপরে ‘গল্পভাবনা’। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে সমাদৃত ঋত্বিক ঘটক। নিজের ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। ঘনিষ্ঠতা ছিল নাট্যজগতের সঙ্গে। নাটক রচনা করেছেন। তবে তিনি যে ছোটগল্প লিখতেন, সেই কথা অনেকেরই অজানা। জীবৎকালে তাঁর কোনও গল্প-সংকলন প্রকাশ পায়নি। ১৯৮৭-র ৪ নভেম্বর ‘ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সতেরোটি গল্পের একটি সংকলন। গল্পগুলো কেমন? নির্মেদ আলোচনায় জানিয়েছেন সুমিতা চক্রবর্তী, ‘ঋত্বিক ঘটক : যিনি গল্পকাররূপে বিস্মৃত’ রচনায়। প্রচেত গুপ্তর লেখার শিরোনাম ‘সিলেবাসের বই পড়ার অভ্যেস বাড়াতে পারে’। মানুষের বই পড়ার অভ্যেস যে বিন্দুমাত্র কমেনি, নিখুঁত যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘কে বলে বই পড়ার উৎসাহ অনেক কমে গিয়েছে? বইমেলায় এত বই বিক্রি হয় কী করে? আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশ কয়েকজনকে চিনি, যাঁরা বইয়ের জন্য উন্মাদ।’ এই উন্মাদনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক।
নানা রঙের গল্প লিখেছেন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কথাকারেরা। শেখর বসুর ‘স্বপ্ন’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলেন কে’, রণজিৎ দেবের ‘সোনাঝুরি চা-বাগান’, বিপুল দাসের ‘পতনকালীন আর্তনাদ’ বারবার পড়ার মতো। এ ছাড়াও মনে দাগ কাটে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, অনুরাধা কুণ্ডা, শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী, শুভময় মণ্ডল, মানস সরকারের গল্পগুলো। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেছেন জয়ন্ত সরকার। আলোকিত বিভাগ গল্পবিশ্ব। আর্জেন্টিনীয় সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর গল্প অনুবাদ করেছেন অংকুর সাহা। সবমিলিয়ে কুড়ি বছরের এই পত্রিকা উপহার দিয়েছে ১৪০ পৃষ্ঠার অনবদ্য একটি সংখ্যা। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ। দাম
১৫০ টাকা।