রাখিবন্ধন উৎসব যা সুরক্ষা, ভালবাসা ও আস্থার অটুট বন্ধনকে উদযাপন করে।
প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় রাখিবন্ধন উৎসব। এই দিন বোনেরা তাঁদের ভাইয়ের হাতে পরম যত্নে রাখি বেঁধে দেন।
এবং ভাই বোনকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। আর বোন ভাইয়ের দীর্ঘায়ু এবং সুখের জন্য প্রার্থনা করেন।
রাখি কেবলমাত্র সুতো নয়। এটি ভাই-বোনের সম্পর্কের অমূল্য বন্ধনকে মজবুত করার একটি প্রতীকও বটে।
আরও পড়ুন-ধর্ষিতার মৃত্যু যোগীরাজ্যে, সাড়ে ৭ মাস পরও অধরা অভিযুক্ত
কিন্তু আমরা কি জানি যে এই রাখিবন্ধন উৎসব-এর পেছনের পৌরাণিক কাহিনিটি কী?
কেন এই উৎসব পালন করা হয়?
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ যখন শিশুপাল বধ করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন তখন শ্রীকৃষ্ণের তর্জনী কেটে রক্তপাত শুরু হয়েছিল। সেই সময় দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচলের টুকরো ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এই অভাবনীয় ঘটনায় অভিভূত শ্রীকৃষ্ণ অনাত্মীয় দ্রৌপদীকে আজীবন রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর বহু বছর পরে পাশা খেলায় ভরাসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন।
কাপড় বেঁধে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী তা তৈরি হয় তুলো অর্থাৎ সুতো দিয়ে। সেই সুতোরই বন্ধন।
অর্থাৎ সুরক্ষার বন্ধন।
আবার প্রাচীনকালে উপাকর্ম বলে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল।
বিশেষ এই দিনে ব্রাহ্মণরা তাঁদের উপবীত বদলাতেন। উপবীতও একপ্রকার বন্ধনই। এইভাবে রক্ষাবন্ধনের ইতিহাস রয়ে যায় লোকাচার মহাকাব্য আর কিংবদন্তিতে। মহাকাব্যের যুগ থেকেই এই রাখিবন্ধন উৎসব পালিত হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়।
ভগবত পুরাণ এবং বিষ্ণু পুরাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান বিষ্ণু যখন রাজা বলিকে পরাজিত করে দিনটিতে জগতের অধিকার নিয়েছিলেন তখন বলি আশীর্বাদস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুকে তাঁর প্রাসাদে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণুর অনুরোধে রাজি হলেন। এর ফলে ভগবান নিজে আটকে গেলেন। সব দেখে-বুঝে মা লক্ষ্মী নারদ মুনির পরামর্শ নিলেন। এবং শ্রাবণ পূর্ণিমার দিনে রক্ষা সুতো বেঁধে বলিকে ভাই বানিয়ে নেন। এতে বলি লক্ষ্মীকে কাঙ্ক্ষিত উপহার চাইতে বললে মা লক্ষ্মী রাজা বলিকে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপহার চেয়েছিলেন।
যমের অমরত্বের প্রার্থনা করে তাঁর বোন যমুনা যমের হাতে একটি রাখি পরিয়ে দেন। এরপরই যমরাজ কথা দেন যে যাঁর হাতে তাঁর বোন রাখি পরিয়ে দেবেন তাঁকে তিনি স্বয়ং রক্ষা করবেন।
গণেশ তাঁর বোনকে রাখি পরিয়ে দিলে তাঁর সন্তান শুভ আর লাভের খুব মনোকষ্ট হয় নিজেদের বোন না থাকার কারণে। নিজেদের বোনের জন্য গণেশকে অনুরোধ করলে গণেশ তখন মন্ত্রের সাহায্যে অগ্নি থেকে এক কন্যাকে উৎপন্ন করেন। সেই মেয়ে তখন শুভ ও লাভের হাতে রাখি পরিয়ে দেন।
এ তো গেল রাখিকে ঘিরে মহাকাব্যের পৌরাণিক ইতিহাস। এবার দেখি ইতিহাসের পাতায় রাখিবন্ধনকে নিয়ে কী কী কাহিনি রয়েছে।
কিংবদন্তি অনুসারে মহামতি আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন তাঁর স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। হিদাস্পিসের যুদ্ধকালে আলেকজান্ডারকে কোনওরকম আঘাত করেননি পুরুরাজ। শেষ পর্যন্ত পুরু এই যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হন।
রাজস্থানের লোকগাথা অনুসারে, গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে অসহায় বিধবা রানি কর্ণাবতী দিল্লির বাদশা হুমায়ুনকে একটি রাখি ও চিঠি পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণাবতীর পাঠানো রাখি পেয়ে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য প্রচুর সৈন্য পাঠান।
সেনা পাঠানোয় দেরি হওয়ায় বাহাদুর শাহর দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কর্ণাবতীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি হুমায়ুন ভোলেননি।
রানি কর্ণাবতী জহরব্রত করে আগুনে ঝাঁপ দিলেও তাঁর সন্তান বিক্রমজিৎ সিংহকে চিতোরের রাজা করেন হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে উৎখাত করে।
পাঞ্জাবি সংস্কৃতিতে রক্ষাবন্ধনের উৎসবটি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। খালসা বাহিনী পাঞ্জাবে রাখি শব্দটি চালু করেছিল। তারা তাদের ফসলের ভাগের বিনিময়ে মুঘল ও আফগান সেনাদের হাত থেকে জমি কৃষকদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আরেকটু অন্যদিকে তাকালে আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হল মহারানির জিন্দানের নেপালের রাজাকে রাখি পাঠানো। মহারাজ রঞ্জিত সিং শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মহারানি জিন্দান রক্ষাবন্ধন উদযাপন করতে খুব পছন্দ করতেন। মহারানি জিন্দান নেপালের রাজার কাছে রাখি পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে নিজের বোন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নেপালে রাজা তাঁকে রক্ষা করার জন্য তাঁর প্রতিজ্ঞাকে সম্মান করেছিলেন এবং শিখ সাম্রাজ্যের পতন হলে তাঁকে নেপালে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
রাখিবন্ধন উপলক্ষে আজও অমৃতসর জেলার বাঁকড়ায় অনুষ্ঠিত হয় রাখি উপলক্ষে মেলা। পাঞ্জাবের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে রাখিবন্ধনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
রাখিবন্ধন উৎসব হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও রয়েছে। রাখি উৎসবকে অনেক অঞ্চলে শ্রাবণীও বলা হয়।
রাখিবন্ধন উৎসব নিয়ে নানান কাহিনি থাকলেও মূলত এই উৎসব ভাই-বোনের ভালবাসা কিংবা নিরাপত্তা বা সম্প্রীতির। আবার বলা যায় সৌভ্রাতৃত্বেরও। সৌভ্রাতৃত্বের ভাবধারাকেই জনমনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বঙ্গভঙ্গের আইনের বিরুদ্ধে সকলকে একযোগ করে রুখে দাঁড়াতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাক দিয়েছিলেন। ঐক্যবন্ধন সহযোগে বিলি হয়েছিল প্রচার পত্র। সকলের হাতে রাখি পরিয়ে বন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন রবি ঠাকুর।
মহাকাব্য, পুরাণ, ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাখিবন্ধন-সংক্রান্ত কাহিনিগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধনের কথা এসেই যায়।
তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, রাখি বা রক্ষাবন্ধন উৎসবকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই আচার কিন্তু সর্বোপরি বন্ধন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথা বলে যুগ যুগ ধরে।
আরও পড়ুন-পাশে বজরং-সাক্ষী-সহ অনেকেই, বিমানবন্দরে মানুষের ঢল
রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাই চেয়েছিলেন।
সে এক উত্তাল সময়। উনিশশো পাঁচ সাল। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করলেন। অবিভক্ত বাংলাকে প্রশাসনিক কারণে ইংরেজ শাসকরা ঠিক করলেন ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হবে। বাংলাতে হিন্দু জনসংখ্যার আধিক্যযুক্ত অঞ্চল আলাদা করা হবে মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলা থেকে। বাংলার মুসলিমরাও এই প্রস্তাব খুশি মনে মেনে নিয়েছেন। তখনকার অবিভক্ত বাংলা মানে কিন্তু বাংলা-বিহার-আসাম-শ্রীহট্ট সবটা মিলে। ততদিনে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে বাংলা।
ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে ভাগ করে দিয়ে বিদ্রোহের গতি রুদ্ধ করা। অতএব পাশ হয়ে গেল বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব।
তখন শ্রাবণ মাস। হিন্দু ঘরের মেয়েরা তাঁদের ভাইদের হাতে রাখি পরিয়ে অটুট ও পবিত্র ভালবাসার সম্পর্ককে দৃঢ় করে।
রবীন্দ্রনাথের মাথায় এল অন্য ভাবনা। শুধু ভাইবোনে কেন আবদ্ধ থাকবে এই উৎসব?
হিন্দু-মুসলিম এক হলে কেমন হয়?
রাখিবন্ধন উৎসব তবে হোক সম্প্রীতির উৎসব। সৌভ্রাতৃত্বের উৎসব। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের হাতে ভালবেসে রাখি পরিয়ে দেবে। অন্য ধর্মের মানুষের হাতে হাত রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেওয়া হল প্রতীকী প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথের ডাকে ধর্মনির্বিশেষে সারা বাংলা এক হয়েছিল সেদিন।
গান লিখলেন তিনি—
‘বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান।’
শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, রাখি নিয়ে কবি নজরুলও লিখেছিলেন ভারি সুন্দর একটি কবিতা।
‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে
স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী
নীলিমা বাহিয়া সাওগাত নিয়া
নামিছে মেঘের তরণী।’
নামিছে মেঘের তরণী।